শেরপুর থেকে কাজি মাসুম: বিলপ্ত হয়ে যাচ্ছে শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার তাঁতশিল্প। এক সময় গারো পাহাড়ের বিভিন্ন আদিবাসী পল্লিতে দিনরাত এসব তাঁতের খটখট আওয়াজ পাওয়া গেলেও আজ সে শব্দ তো দুরের কথা তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত কারিগর এবং তাঁতের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই ভার হয়ে উঠেছে। তবে দু’একটি গ্রামে সে তাঁতশিল্পকে ধ্বংসস্তুপের মতো পড়ে থাকতে দেখা যায় আদিবাসীদের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক তাঁত মেশিনগুলো। অথচ এক সময় এ এলাকার গারো, কোচ, ডালু, বানাই, হদি, বর্মনসহ বিভিন্ন আদিবাসী গোত্রের মানুষ নিজেদের ঐতিহ্যবাহি পোষাক নিজেরাই তৈরী করে ব্যবহার করতো। যাদের তাঁত ছিলো না তারা গ্রামের ওইসব তাঁতের তৈরী করা গামছা, লুঙ্গি, মেয়েদের ওড়না, দক শাড়ী, দক মান্দা, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোষাক কিনে ব্যবহার করতো। কিন্তু এখন তা কালের করালগ্রাসে সে ঐতিহ্য হারিয়ে বাঙালিদের পোষাক পরতে বাধ্য হচ্ছে।
শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার সীমান্তের নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবরদীসহ জেলার সদর ও নকলা উপজেলা মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার আদিবাসীর বসবাস। এদের মধ্যে পাহাড়ি এলাকার আদিবাসীরা শতশত বছর ধরে তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখে নিজেদের পোষাক নিজেরাই তৈরী করে ব্যবহার করে আসছিলো। কিন্তু জীবন-জীবিকার তাগিদে এসব তাঁতশিল্প ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়া ও সুতার মূল্য বৃদ্ধি সহ নানা প্রতিকুল পরিবেশের কারণে এ এলাকার আদিবাসী বিশেষ করে গারো ও কোচ সম্প্রদায় মানুষ আরো প্রায় ৮ থেক ১০ বছর আগেই তাদের তাদের সে ঐতিহ্যের তাঁত বন্ধ করে দেয়। ফলে ওইসব আদিবাসী গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের বাড়িতে ঘুন ও উলু ধরা কাঠের তাঁতগুলো এখন নিথরভাবে পড়ে আছে। আদিবাসীদের সেই ঐতিহ্যের বিলুপ্ত প্রায় কালের সাক্ষি হয়ে থাকা দু’চারটে তাঁত মেশিন এখনও চোখে পড়ে।
এসব এলাকায় এক সময়কার তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত গারো ও কোচ তাঁতিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখনও যদি তাদের এ ঐতিহ্য এবং শিল্পকে রক্ষা করতে চায় তবে সরকারের আশু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। যদিও অনেক আগেই এ শিল্পের কারিগররা এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশার সাথে যুক্ত হয়েছে। আবার কেউ কেউ কাজের সন্ধানে ঢাকায় পরিজমিয়েছে জীবীকার তাগিদে।
জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলার রাংটিয়া কোচপাড়ার জাগেন্দ্র কোচ জানান, গত ৮/১০ বছর আগে আমার ৮টি তাঁত ছিলো। এখানে আমরা আমাদের গামছা, লুঙ্গি, মহিলাদের ওড়না, দক শাড়ী, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোষাক বুনতাম। কিন্তু প্রথমে সুতার মূল্যবৃদ্ধির কারণ এবং পরে শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় তাঁতকলগুলো চালু রাখা সম্ভব হয়নি। এদিকে বাজার থেকে টেক্সটাইলের শাড়ী-লুঙ্গির দাম অনেক কম থাকায় আমাদের গোত্রের লোকজন সেই পোষাকের দিকে ঝুকে পড়ে। ফলে আমাদের এ তাঁত আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। অথচ আমাদের শতভাগ সুতার তৈরী পোষাক বিশেষ করে গামছা, লুঙ্গি, দক শাড়ী টেক্সটাইলে তৈরী পোষাকের মতো আরাম দায়ক নয়। তারপরও জীবীকার তাগিদে খরচ বাঁচাতে আমাদের এ তাঁত বন্ধ করতে হয়েছে এবং টেক্সটাইলের পোষাক পড়তে হচ্ছে।
একই গ্রামের তাঁতশ্রমিক প্রনব কোচ জানায়, আমিতো অনেক আগেই ঢাকায় একটি হোটেলে বাবুর্চির চাকুরি করছি। এলাকারতাঁতগুলো আবারও চালু হলে ঢাকায় আর থাকতাম না।
আদিবাসী নারী রায়তি কোচ বলেন, আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী দক শাড়ী পরা বাদ দিয়ে বাঙালিদের শাড়ী পরতে বাধ্য হইছি। এহন এ তাঁত চালু হইলে আমগো ভালো হইতো।
একই উপজেলার ভারুয়া জারুলতলা গ্রামের আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের মিত্র সাংমা বলেন, আমার ছিল ৬টি তাঁত মেশিন। প্রায় ৮ বছর আগে এখানে পোষাক তৈরী করে বিক্রি করে না পোষালে চলে যাই মধুপুর কারিতাসের একটি তাঁতশিল্পে। সেখানে মাসে ১৫ হাজার টাকায় বেতনে তাঁতের কাজে যুক্ত হই। ফলে বাড়ির এ তাঁতটি নষ্ট হয়ে পড়েছে। ভাবছি মধুপুরের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে আবারও এই তাঁতগুলোসংস্কার করে পুনোরায় কাজ শুরু করবো। কিন্তু অর্থের অভাবে কাজ ধরতে পারছি না। এমতাবস্থায় আমরা যদি সরকার থেকে আর্থিক সুযোগ পাই তবে এ শিল্প ও আমাদের গারোদের ঐতিহ্য একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো যাবে।
আদিবাসী কোচ নেতা যোগেন কোচ বলেন, আমাদের ঐতিহ্যের তাঁত ও পোষাক রক্ষায় এক সময় কারিতাস কিছু সহযোগীতা করলেও এখন আর কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। তবে সরকার থেকে কোন সহযোগিতা পেলে আবার আমাদের এই ঐতিহ্য ফিরে আসতে পারে। ইতিমধ্যে দেশের পার্বত্য এলাকার চাকমা ও মণিপুরি তাঁত সরকারী ও বেসরকারী নানা সংস্থার সহযোগীতায় বিলুপ্তের হাত থেকে বেঁচে উঠেছে। আমরাও চাই আমাদের শেরপুরের আদিবাসীদের প্রতিসরকার ও বেসরকারী কোন সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।
এ বিষয়ে শেরপুর বিসিক শিল্পনগরী কর্মকর্তা এস এম রেজুয়ানুল ইসলাম জানায়, আমরা আদিবাসীদের এতিহ্য ও তাঁত শিল্পের জন্য সকল প্রকার সহযোগিতা করবো। তারা যদি তাদের এ শিল্পকে রক্ষায় আমাদের কাছে আসে তাহলে আমরা বিপণন ও ঋণ সহায়তা দিতে পারবো।