প্রযুক্তি নির্ভর দুনিয়ায় অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র ‘ফ্রিল্যান্সিং’
20, December, 2020, 11:33:48:AM
বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির কল্যাণে উন্নয়নের জোয়ারে লেগেছে নতুন হাওয়া। প্রযুক্তির ছোঁয়া এখন আর শুধু উন্নত দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই, তুলনামূলকভাবে কম উন্নত দেশগুলোতেও উন্নয়নের মাত্রায় যোগ করেছে ভিন্নতা। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেকোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গভীরভাবে তরান্বিত করে। প্রতিযোগিতামূলক এ যুগে তথ্যপ্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ দেশসমূহের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা তাই সঙ্গত কারণে উচ্চমুখী থাকে।
ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্তপেশা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এক ব্যতিক্রমধর্মী ফসল। ক্ষুদ্রার্থে এটি যেমন ব্যক্তির অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারে বৃহদার্থে সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। ফ্রিল্যান্সিং বলতে মূলত বুঝায় কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অধীনে না থেকে মুক্তভাবে কাজ করা। এ ধরণের কাজ যারা করেন, তাদের কে ফ্রিল্যান্সার বা মুক্তপেশাজীবী বলা হয়। ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজগুলো প্রধানত পার্ট টাইম কাজ হয়ে থাকে। ১৯৯৮ সালে অনলাইন মার্কেটপ্লেস খোলার মধ্য দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থান জোগানের সম্ভাবনাময় খাতগুলোর অন্যতম একটি খাত ফ্রিল্যান্সিং। দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বেড়ে চলছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে চাকরির বাজারের অবস্থা বেশ নাজুক। দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেও অনেককে দীর্ঘসময়ের জন্য বেকার থাকতে হচ্ছে। নেই পর্যাপ্ত চাকরির ক্ষেত্র। দেশের ৪৭ শতাংশ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার। অপর্যাপ্ত চাকরিক্ষেত্র, বিকল্প কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা সহ নানাবিধ কারণে দেশে বেকারত্বের হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এমতাবস্থায়, বিকল্প কর্মসংস্থানের জোগান নিয়ে হাজির হয়েছে ফ্রিল্যান্সিং। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করার বিষয়টি আজ আর আমাদের দেশে নতুন নয়। ফ্রিল্যান্সাররা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নামীদামী কোম্পানি, কর্পোরেট অফিসে কাজ করার মাধ্যমে অনায়াসেই অর্থ উপার্জন করে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক বোদ্ধাদের ভাষ্যমতে, ফ্রিল্যান্সিং জগতের শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশি কর্মীরা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশসমূহ শত শত কোটি টাকার কাজ করিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশি দক্ষ কর্মীদের নিয়ে।
বৈশ্বিক ফ্রিল্যান্সিং বাজারের বড় এক গন্তব্য বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান মতে, এ খাতের শতকরা ১৬ শতাংশ বাজার দখল করে আছে বাংলাদেশি কর্মীরা। দেখা যায় যে, ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজে জড়িত বেশিরভাগ কর্মী আসছে দেশের তরুণ ও যুবসমাজ হতে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের এমন অনেকে আছেন যারা এখন ধরাবাঁধা নিয়মের ও গতানুগতিক চাকরির থেকে স্বাধীন ভাবে অনলাইনে কাজের প্রতি বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) এর এক তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি ফ্রিল্যান্সার কাজ করে চলেছেন। যাদের পাঁচ লাখ কাজ করেন মাসিক আয়ের ভিত্তিতে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ তরুণ। আমাদের দেশ তারুণ্যনির্ভর দেশ। তাই তরুণদের ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারলে অর্থনৈতিক ভাবে আরো এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারবে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাপী ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এর কাজের পরিধি বেশ ব্যাপক। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে ওয়েব ডেভেলপিং, গ্রাফিক্স ডিজাইনিং, কনটেন্ট রাইটিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সহ আরো অনেক কিছু এর পরিধির আওতাভুক্ত। তাছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কাজের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটকে আরো বিস্তৃত করে তুলছে। এখানে কাজগুলো ক্লায়েন্ট ও ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে নিদির্ষ্ট একটি চুক্তির ভিত্তিতে হয়ে থাকে। আর সে ক্লায়েন্ট হতে পারে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। চুক্তির উপর ভিত্তি করে ক্লায়েন্টরা ফ্রিল্যান্সারদের কাজ দিয়ে থাকেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফ্রিল্যান্সারকে তার কাজটি সম্পন্ন করে চুক্তিবদ্ধ ক্লায়েন্টকে জমা দিতে হয়। এর বিনিময়ে একজন ফ্রিল্যান্সার পেয়ে যান চুক্তি অনুসারে তার কাজের পারিশ্রমিক। প্রযুক্তির সুবাধে এ কাজগুলো ফ্রিল্যান্সার ও ক্লায়েন্টরা খুব সহজে করে নিতে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে অবস্থান করেও।
বেশ মজার ব্যাপার হলো ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজগুলো ইন্টারনেট ভিত্তিক হওয়ায় এখানে কোনো ধরাবাঁধা অফিস টাইম নেই। যেকোন সময়ে, যেকোন স্থান থেকে একজন ফ্রিল্যান্সার তার সুবিধামত কাজগুলো সহজে করে ফেলতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ে পরিপাটি হয়ে তাকে কর্মক্ষেত্রে ছুটার ভাবনা ভাবতে হয় না। এতে করে যাতায়াত খরচ ও সময়ের অপচয় হয় না।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের নারীরাও এখন আর পিছিয়ে নেই। বৈশ্বিক ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ রেখে চলছে একের পর এক। যেহেতু ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজগুলো বাসায় বসে নিজেদের পছন্দমতো সময়ে করা সম্ভব, সেক্ষেত্রে শিক্ষিত ও দক্ষ গৃহিণীরা তাদের কাজের ফাঁকেও এ ধরনের কাজে যুক্ত হতে পারে অনায়াসেই। এতে করে নারীরা স্বনির্ভর হতে পারছে। তাদের পরিবারকে দিতে পারছেন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। এতে করে সমাজে নারীদের সম্মান বৃদ্ধি পাচ্ছে অনেকাংশে।
বেকারত্ব লাঘবে ভূমিকা রেখে চলছে ফ্রিল্যান্সিং। দেশের কয়েক লাখ মানুষ এখন এর দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ‘গিগ ইকোনমি’র নাম আমরা অনেকে কম-বেশি শুনেছি। গিগ ইকোনমি বা গিগ অর্থনীতি হচ্ছে একধরণের খন্ডকালীন কাজের ক্ষেত্র। যেখানে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্থায়ীভাবে কর্মী নিয়োগ না করে বিশেষ কিছু শর্তসাপেক্ষে স্বল্প সময়ের জন্য কর্মী নিয়োগ দিয়ে দিয়ে থাকেন। গিগ ইকোনমিতে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশে অবস্থান। এই বিশাল অর্জনের ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ভূমিকা অপরিসীম।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের বহুল সম্ভাবনা থাকলেও আমাদের দেশে এখনো সুপরিচিত হয়নি। এর প্রচারে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আমাদের দেশে কর্মীর অভাব নেই, কিন্তু দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সরকারি উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য বিনামূল্যে বা সূলভ মূল্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি, সরকারি হস্তক্ষেপের পাশাপাশি কর্মীদের নিজ জায়গা থেকে প্রচেষ্টার দ্বারা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটের পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
লেখক- তানভীন সুইটি শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ৩য় বর্ষ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।