কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসে এমআরপি পাসপোর্ট প্রদানে ব্যাপক জালিয়াতি
8, June, 2022, 4:32:39:PM
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি:
কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জাহিদুল হক গত বছরের ১২ই মে কুষ্টিয়াতে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৩০৬টি এমআরপি পাসপোর্ট অবৈধ এবং নিয়ম বর্হিভূত ভাবে প্রদান করেছেন বলে জানা যায়।
কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জাহিদুল হক রাঙামটিতে চাকুরীতে থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে মোটা টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যু এবং সেবা নিতে আসা যুবককে মারধর সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
পাসপোর্ট সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২২ জানুয়ারি থেকে রাজধানীর আগারগাঁও, যাত্রাবাড়ী এবং উত্তরা পাসপোর্ট অফিস থেকে ই-পাসপোর্ট বিতরণ হয়। যা একযোগে দেশের অভ্যন্তরে ৬৪টি জেলার ৬৯টি পাসপোর্ট অফিস, ৩৩টি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট, বিদেশস্থ ৭৫টি বাংলাদেশ মিশনে চালু করা হয়। কিন্তু কিছু শর্ত সাপেক্ষে পূর্বের এমআরপি পাসপোর্ট সেবাও চলমান রাখা হয়।
এমআরপি পাসপোর্টের পরিবর্তে ই-পাসপোর্ট চালুর পর থেকে শুধুমাত্র বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিক যারা এনআইডি এবং ডিজিটাল জন্ম সনদ করতে পারেনি শুধুমাত্র তাদের জন্য বিশেষ বিবেচনায় এমআরপি পাসপোর্ট ইস্যু করার কথা বলা হয়।
এক্ষেত্রে শর্ত হিসেবে বলা আছে, আবেদনকারীর পূর্বের পাসপোর্টে অবস্থানকারী দেশের মেয়াদসম্পন্ন বৈধ ভিসা থাকতে হবে, থাকতে হবে কনফার্ম এয়ার টিকেট, বৈধ ওয়ার্কপারমিট অথবা ঐ দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে ট্রাভেল পাস, হালনাগাদ ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ, এনআইডি করতে দেওয়ার বৈধ প্রমান পত্র এবং এই সমস্ত ডকুমেন্টস এর সাথে পাসপোর্ট ইস্যু করতে অবশ্যই বিভাগিয় পাসপোর্ট কর্মকর্তার অনুমোদন লাগবে। যাদের ভোটার আইডি কার্ডে সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য আবেদনকৃত অফিসের জেলায় ঠিকানা ব্যবহার করতে হবে।
কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসের সূত্র থেকে জানা যায় জাহিদুল হক যোগদানের পর থেকে একবছরে সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় সব জেলার ৩৩০৬টি এমআরপি পাসপোর্ট কোন প্রকার এসবি ভেরিফিকেশন এবং বিভাগীয় কর্মকর্তার অনুমোদন ছাড়াই কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে ইস্যু করা হয়েছে। সূত্রের দেওয়া তথ্য মতে, এর মধ্যে রোহিঙ্গা এবং ভারতীয় নাগরিকও থাকতে পারে।
এই ৩৩০৬টি পাসপোর্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অল্প বয়স্ক নারীও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন কোন নারী পাচারকারী চক্রও জড়িত থাকতে পারে এই সমস্ত কর্মকান্ডের সাথে।
সরেজমিনে কুষ্টিয়ায় আবেদনকৃত এমআরপি পাসপোর্টের কিছু আবেদন যাচাই বাছাই করে দেখা যায়, তারা কুষ্টিয়া জেলার যে ঠিকানা ব্যবহার করেছে, তারা অদৌও সেখানে কোন সময় বসবাস করনেনি। যা সম্পূর্ণ ভূয়া। জাহিদুল হকের নিয়োগের পর থেকে প্রাায় ৩৩০৬টি এমআরপি পাসপোর্ট নিয়ে ইতিমধ্যে ধ্রুমজাল সৃষ্টি হয়েছে। যা তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। উল্লেখ্য পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জাহিদুল হকের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ইস্যু করারও অভিযোগ আছে।
বর্তমানে কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জাহিদুল হকের চাকুরী জীবণের অতীত রেকর্ড থেকে জানা যায়, কুষ্টিয়াতে আসার পূর্বে তিনি রাঙামাটি পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত ছিলেন। যেখানে তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট নবায়নে একাধিকবার ঘুষ না দেওয়ার কারণে বিদেশগামী যুবককে মারধরের অভিযোগ উঠেছিলো। যার একটি ভিডিও এই প্রতিবেদকের নিকট সংগৃহিত আছে।
এসব বিষয়ে জাহিদুল হক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন তাকে কেউ কিছু করতে পারবে না, কারন তার মামা আছে পাসপোর্ট অফিসে বড় কর্মকর্তার পদে।
এছাড়াও সময় টিভির একটি প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে মোহাম্মদ জাহিদুল হকের দুর্নীতির বিষয় যা সেই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ক্ষতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন। সময় টিভির ঐ প্রতিবেদনে দেখা যায়, খাগড়াছড়িতে কর্মরত অবস্থায় তার বিরুদ্ধে লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ইস্যুর অভিযোগ উঠেছেছিলো এবং যার বিভাগীয় তদন্ত চলমান। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট দ্রুত ডেলিভারী দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের সত্যতা পায় কেন্দ্রীয় পাসপোর্ট অফিস। যার প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাকে চাকুরী থেকে কেন বরখাস্ত করা হবে না মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় মন্ত্রণালয়।
কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিস থেকে ৫০০১০০০০০৩৮০৭১৩ এনরোলমেন্ট আইডির এমআরপি পাসপোর্ট গ্রহীতা ঢাকা নবাবগঞ্জের আরমিন আক্তার পাসপোর্ট করার সময় পাসপোর্ট ফরমে যে ফোন নাম্বার ব্যবহার করে কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট করেছেন সেই ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন আমি পাসপোর্ট কুষ্টিয়া থেকে করিনি। ফিঙ্গার প্রিন্টের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ঢাকাতে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েছি।
কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিস থেকে ৫০০১০০০০০৩৮০৭১৩ এনরোলমেন্ট আইডির এমআরপি পাসপোর্ট গ্রহিতা মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন পাসপোর্ট করার সময় পাসপোর্ট ফরমে যে দুইটা ফোন নাম্বার ব্যবহার করে কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট করেছেন, সেই ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বাঞ্চারামপুরের এক মহিলা ফোন ধরেন এবং অপর ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে সাতক্ষীরার একজন ফোন ধরেন। তারা কেউই মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেনকে চিনেন না বলে জানান। অথচ মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন কুষ্টিয়া থেকে পাসপোর্ট করার সময় চাঁদপুরের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন।
কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিস থেকে ৫০০১০০০০০৩৮০৭১৪ এনরোলমেন্ট আইডির এমআরপি পাসপোর্ট গ্রহিতা মোছাঃ শিলা খাতুন নাটোরের যে ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার ব্যবহার করে কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট করেছেন, সেই ঠিকানায় যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যাওয়ানি। ফোন নম্বারে যোগাযোগ করা হলে মোছাঃ শিলা খাতুন এর স্বামী মোঃ আজিজুল হাকিম বলেন, গত তিন বছরের অধিক সময় তার সাথে আমার কোন যোগাযোগ নাই । সে যদি আমার ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে পাসপোর্ট করে থাকে তাহলে প্রতারণা করেছে।
এদিকে ৩৩০৬টি এমআরপি পাসপোর্ট কোন জেলার মানুষকে প্রদান করা হয়েছে মর্মে জানতে চাইলে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জাহিদুল হক সেই তথ্য দিতে অপরগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের তথ্য দিতে আমি বাধ্য নই। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
রাঙামটিতে থাকাকালীন মারধরের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কিছু বলতে চাইলে আমার সামনে এসে বলেন। এরপর তিনি ফোনটি কেটে দেন।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরীর (এসজিপি, পিবিজিএমএস, এনডিসি, পিএসসি) মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডকুমেন্টস এবং সিরিয়াল নাম্বার তার অফিসে দেওয়ার জন্য বলেন।