বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ, pure mathmetics এ বাংলাদেশের প্রথম ডক্টরেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক মরহুম ড. মোঃ আব্দুল কুদ্দুসের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আগামীকাল বৃহস্পতিবার। তিনি ২০০৬ সনের ১২ সেপ্টেম্বর নিঃসন্তান অবস্থায় চাকরিকালীন মৃত্যুবরণ করেন।
মরহুম প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল কুদ্দুস ১৯৪৮ সনের ২৫ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রাম বানিয়াচং এর প্রথমরেখে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মোঃ পারু মিয়া ছিলেন গ্যানিংগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির আজীবন সেক্রেটারি, এল আর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, জনাব আলী সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও বানিয়াচং সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা। তার মা মরহুমা খায়রুন্নেসা খানম ছিলেন সাগরদিঘির পশ্চিম পারের ঐতিহ্যবাহী খান পরিবারের মেয়ে।
ড. মোঃ আব্দুল কুদ্দুস শিক্ষাজীবন শুরু করেন চৌধুরী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে দুই বছর পড়াশোনা করে ভর্তি হন উপমহাদেশের শতোর্ধ্ব প্রাচীন বিদ্যাপীঠ বানিয়াচং এল আর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্কুলে বরাবরই প্রথম স্থান অধিকার করতেন। এ স্কুল থেকে ১৯৬৪ সনে বিজ্ঞান বিভাগে ৩ টি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এই ব্যাচটি এখন পর্যন্ত স্কুলের সেরা ব্যাচ এবং ড. আব্দুল কুদ্দুস স্কুলের সেরা ছাত্র।
মেট্রিক পাসের পর তিনি সিলেট এমসি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬৬ সনে কৃতিত্বের সাথে আইএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে এমএসসি পাস করেন। তিনি সেই সময় চাকরিতে যোগদান না করে ১৯৭২ সনে পিএইচ.ডি গবেষণা শুরু করেন এবং ১৯৮১ সনের ১৩ নভেম্বর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ও ঢাবির তৎকালীন ট্রেজারার ড. মোঃ রমজান আলী সরদারের তত্ত্বাবধানে পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তার পিএইচ.ডির বিষয় ছিল- Theory of generalized function. এটি বিশুদ্ধ গণিতের (pure mathematics) একটি অত্যন্ত কঠিন বিষয় কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ইতিহাসে বিশুদ্ধ গণিতে (pure mathematics) তিনিই প্রথম ডক্টরেটধারী ব্যক্তিত্ব, গণিত শাস্ত্রে তৃতীয় ডক্টরেট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩৫তম ডক্টরেট।
উল্লেখ্য যে, অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীনই তার সাথে পরিচয় ঘটে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা, প্রথম মুসলমান নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুস সালামের সাথে। কথায় বলে, রতনে রতন চেনে। সালাম সাহেব কিশোর আব্দুল কুদ্দুসের জ্ঞানের প্রখরতা দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হন এবং বাইশ বছরের জুনিয়রের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। ড. আব্দুস সালাম তার প্রতিষ্ঠিত ইটালীর ট্রিয়েস্টিতে অবস্থিত Inntenational centre for theoretical physics এ উচ্চতর গবেষণার জন্য ১৯৮১ সনে ড. আব্দুল কুদ্দুসকে পত্র প্রেরণ করেন। সেই চিঠিটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গায়েব করে ফেলে। সেখানে শুধু বিশ্বের নামকরা প্রফেসররাই গবেষণার সুযোগ পায়। পরের বছর তিনি সেখানে গবেষণা করেন। পরে তিনি অস্ট্রিয়ায়ও পোষ্ট ডক্টরেট করেন। ড. আব্দুল কুদ্দুসের প্রায় অর্ধশত প্রবন্ধ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং সেসব বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়। দীর্ঘ ষোল বছর পর তিনি ১৯৮৬ সনের ১৪ জানুয়ারি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৮৮ সনের ১ অক্টোবর সহকারী অধ্যাপক, ১৯৯৩ সনের ২১ জুলাই সহযোগী অধ্যাপক, ২০০১ সনের ২৭ মার্চ অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।
তার সম্পর্কে চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন সেই সময় ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে তার পাশের কক্ষের বাসিন্দা গবেষক ও বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফা পুষ্প, ‘বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ বইটিতে- কুদ্দুসের দুটি ধনুক ভাঙা পণের কথা আমরা সকলেই জানি। প্রথমটি হল কুদ্দুস ম্যাথমেটিক্স ডিপার্টমেন্টে এসিসট্যান্ট প্রফেসরের চাকরির জন্য অপেক্ষা করবেন। লেকচারার পোস্টে ডাকা হলেও যাবেন না। কারণ, ডক্টরেট পেতে তাকে দশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর থেকে শুরু করলেই এই এতগুলো বছর পুষিয়ে নিতে পারবেন। তাঁর দ্বিতীয় পণটি ডাক্তার ছাড়া অন্য কোনো পেশার মেয়েকে বিয়েই করবেন না। কুদ্দুসকে সাধারণত আমরা মিথ্যা বলতে দেখিনি। আর অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত মুহুর্তটিতেও একটি খারাপ কথা তাঁর মুখটি থেকে বেরিয়ে আসতে শুনিনি। আমাদের কেমন যেন একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে আল্লাহতালা কুদ্দুসের উভয় দাবিই পূরণ করবেন।’
তিনি অবশেষে নবীগঞ্জের বেতাপুর চৌধুরী বাড়ির কাস্টমসের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মরহুম গোলাম রব্বানী চৌধুরীর কন্যা ডাঃ সাহিরা চৌধুরীর সাথে ১৯৯০ সনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৯৩ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. আব্দুস সালামকে ডিলিট ডিগ্রী দেয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক ড. আব্দুল কুদ্দুস অংশগ্রহণ করেননি। বিষয়টি নজরে আসে ড. আব্দুস সালামের। অনুষ্ঠান শেষে তিনি ভিসি প্রফেসর এমাজ উদ্দীন আহমেদকে কৈফিয়ত তলব করে বলেন- Where is my friend Dr,. Abdul Quddus? সাথে সাথে বেশ কয়েকজন শিক্ষক ড. আব্দুল কুদ্দুসকে বাসা থেকে সসম্মানে ড. সালামের কাছে নিয়ে আসেন এবং দুই ঘন্টা তারা একান্তে আলাপ করেন। বিষয়টা তখন তোলপাড় সৃষ্টি করে।
ড. কুদ্দুস আপাদমস্তক শিক্ষক ছিলেন। যে কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। দেশে সম্ভবত তিনিই একমাত্র উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব যিনি টার্গেট পূরণের জন্য ষোল বছর বেকার ছিলেন। তিনি ছিলেন বানিয়াচং এর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রথম ডক্টরেট, প্রথম সর্বোচ্চ চাকরিজীবী (সচিব পদমর্যাদা), সিলেট বিভাগে গণিত শাস্ত্রে প্রথম ডক্টরেট। দেশপ্রেমিক ড. কুদ্দুসকে ড. আব্দুস সালাম তার ইতালিস্থ প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি। এমনকি কোথাও চাকরির জন্য আবেদন করেননি।
ড. আব্দুল কুদ্দুস সাতটি ভাষা জানতেন- বাংলা, ইংরেজি, হিন্দী, আরবি, ফরাসি, উর্দু ও জার্মান। তিনি পাকিস্তান, ভারত, ইতালি ও অস্ট্রিয়া ভ্রমণ করেন। ড. আব্দুল কুদ্দুস ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত প্রচারবিমুখ, সৎ, দেশপ্রেমিক, ধার্মিক ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।