বিশেষ সংবাদদাতা:
দামুড়হুদা-জীবননগর এবং সদর উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে ২০০৮ সাল থেকে লাগাতার ৩ বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের আলী আজগর টগর। নিজ আসনের মানুষের কাছে অনেকটা অপরিচিত টগর এমপি নির্বাচিত হয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের কাছে নিজেকে নতুন রূপে আবির্ভাব ঘটান। আওয়ামী লীগের মূল ধারার বাহিরের সুবিধাবাদী, দুর্বৃত্ত আর দুস্কৃতিকারীদের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব বলয়। অপরাধ জগতের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় চুয়াডাঙ্গার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মার খেতে থাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ। টগর বাহিনীর অত্যাচার-অনাচারের খেসারত দিচ্ছে দামুড়হুদা-জীবননগরের পোড়খাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এমপি টগরের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলদের সম্প্রতি প্রেরিত পত্রে এসব অভিযোগ করা হয়।
সূত্রে জানা যায়, আলী আজগর টগর এমপি হওয়ার পরই শুরু হয় তার দখলদারী ও টেন্ডার বাণিজ্য। দখল করেন এলাকার শিয়ালমারী, ডুগডুগি পশুর হাটসহ তিন তিনটি পশুরহাট, দখল করেছেন, কুড়ুলগাছির রায়সার বিল, শিংনগর বিল, দলকা লক্ষীপুর বিল, মরাগাংনী, উথলী, গুইচিতলা বিলসহ প্রায় ৩০টির মতো জলাশয়। যা থেকে বছরে আয় হয় কয়েক কোটি টাকা।
এছাড়া দেশের ঐতিহ্যবাহী দর্শনার কেরু এন্ড কোং এর ৩ হাজার একর জমি প্রভাব খাটিয়ে নামমাত্র মূল্যে তার এক আত্মীয়ের নামে লিজ নেন। সেখান থেকে বহু কোটি টাকায় আয় করেছেন তিনি। কেরুর ডিস্টিলারী ওয়্যার হাউসসহ সবকিছু তার দখলে রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেরু এন্ড কোং এর একজন কর্মকর্তা জানান, এই কোম্পানীর সবাইকে তার হুকুমে চলতে হয়, না হলেই বিপদ। আর ব্যবস্থাপনা পারিচালক তার কথায় উঠবস করেন।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ বলেন, এমপি টগর কোনদিনই আওয়ামী লীগের লোক ছিলো না, সে আওয়ামী পরিবারের লোক না। কোনভাবে নমিনেশন নিয়ে এসেছে, আমাদের পরিশ্রমের ফসল টগরের পরিবারে উঠেছে, যে পরিবার মুক্তিযুদ্ধেই বিশ্বাস করে না । সে আওয়ামী লীগকে জেতাতে আসেনি, সে আওয়ামী লীগের ঘাঢ়ে চড়ে নিজের পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছে, পরিবারের লোকজনকে পাশ করাতে এসেছে। সে প্রকাশ্যে নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে তার প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে পাশ করিয়ে নিয়েছেন। শেখ হাসিনার নৌকা পেয়ে এমপি হয়ে, শেখ হাসিনারই নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করানোর প্রবক্তা তিনি। গ্রুপিং-লবিং সৃষ্টি করে একটি ভয়ের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। জীবননগর-দামুড়হুদাসহ পুরো এলাকায় তিনি একটি আতঙ্কের নাম। জনগণের নয়, নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন তিনি। বিদ্রোহী সংস্কৃতি চালু করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা জীবননগর-দামুড়হুদা সহ চুয়াডাঙ্গার বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ অমল বলেন, এমপি আলী আজগর টগর এলাকার পশুরহাট, জলমহাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোন কিছুই তার হাত থেকে রেহাই পচ্ছে না। তার মতের বাইরে গেলে বিভিন্ন লাঞ্চনার শিকার হতে হয়।
তিনি বলেন, এমপি আলী আজগর টগর আওয়ামী লীগ নিধনে সিদ্ধহস্ত। তিনি তিন বারের এমপি হলেও বার বার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশকে অমান্য করেছেন। প্রায় ১৫জন নৌকার প্রার্থীকে ভোটে হারিয়ে নিজের লোকদের জয়লাভ করিয়েছেন।
দামুড়হুদা-জীবননগর উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, এই এলাকায় যতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে তা এমপি আলী আজগর টগরের কথায় চলে। তার আত্মীয়স্বজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অযোগ্য হলেও তাদের সভাপতি বানিয়ে কয়েক কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। এতে করে এই এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির নামে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। আর এই সুযোগ গ্রহণ করছেন স্থানীয় জামায়াত-বিএনপির লোকেরা। বঞ্চিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ ঘরানার মানুষ।
নদ-নদীও এমপির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। প্রতিদিন মাথাভাঙ্গা ও ভৈরব নদীর মাটি-বালি উত্তোলন করে বিক্রি করছেন এমপি টগর। হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। এতে যেমন হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য, নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
জানা গেছে, সম্প্রতি জীবননগর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নে সিঙ্গাপুরের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে সোলার প্লান্ট প্রতিষ্ঠা করবে বলে ঐ এলাকার ১৮০ একর ফসলি জমি ভূমি কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক প্রভাবিত করে অনুর্বর জমি মর্মে ঘোষণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রশাসন এই কাজটি করতে অপারগতা প্রকাশ করায় এমপি আলী আজগর টগর জেলা প্রশাসনের উপর ক্ষিপ্ত হন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান। উক্ত ১৮০ একর তিন ফসলি জমি জোরপূর্বক দখল করতে গেলে জমির মালিকগণ এবং স্থানীয় নেতাকর্মীদের প্রবল বাধার মুখে কিছুটা পিছু হটলেও তাদের প্রত্যেকের নামে মামলা দায়ের করে দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করান এবং অদ্যাবধি পুলিশ দিয়ে হয়রানি অব্যাহত রেখেছেন। এইভাবে দুর্নীতির একটি মহাসাম্রাজ্য তৈরি করে দেশে-বিদেশে অঢেল বাড়ি, গাড়ি ও সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
জুরনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব বলেন, আলী আজগর টগর এই এলাকায় দলকে দেউলিয়া করে ফেলেছে। তার বাবা-চাচা মিলে ৪ জন এবং তারা ১১ ভাই কোনদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেননি। তিনি জড়িয়ে পড়ে স্বর্ণ চোরাচালানে। কিছুদিন আগে তার এক কর্মচারী শরিফুল (পিতা ইনসান আলী) স্বর্ণ পাচারকালে নদীতে ডুবে মারা যায়। তার পিঠে থাকা ব্যাগে নাকি ৫ কেজি স্বর্ণ ছিল। আবু তালেব বলেন, এমপি টগর উপজেলা এবং ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে নৌকার প্রার্থীদের হারিয়েছেন। দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কার্যত পুরো উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে দুর্বল করেছেন।
কুড়লগাছী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি কাফিল উদ্দিন টুটুল বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাকে নৌকা প্রতীক দেয়া হয়। দলীয় প্রতীক নৌকা পেয়ে আমি এমপির বাসায় গেলে উনি বলেন, ‘যে তোমাকে নৌকা দিয়েছে সে তোমাকে পাশ করাক, আমি তোমার সাথে নেই।’ অথচ ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তিনি নৌকা পেয়ে এলাকায় আসলে এলাকার মানুষ তাকে চেনে না, এলাকায় একেবারে নতুন মুখ হলেও আমরা তাকে মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে এমপি নির্বাচিত করি। টগর সাহেব উপজেলা নির্বাচনে দামুড়হুদায় নৌকার প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম ঝন্টুর বিপক্ষে তার ভাইকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নৌকার প্রার্থীকে ফেল করান। তার ভাই আলী মনসুর বাবু হলো এলাকার চিহ্নিত চোরাকারবারী ও মাদক ব্যবসায়ী। তার ভাই বাবু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মোস্ট ওয়ানটেড তালিকাভুক্ত হয়ে ভারতে পলাতক ছিলেন। সেখান থেকে তাকে এনে এমপি টগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে পাশ করান।
এমপি টগরের প্রতি অভিযোগ করে এডভোকেট আবু তালেব বলেন, টগরের বাবা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এলাকায় ছাগল জবাই করে উৎসব করেছিলেন। অথচ সেই টগর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে যায়! প্রকৃত আওয়ামী লীগের কোন মানুষ টগরের সাথে নেই। সাথে আছে যুব লীগের ২ কর্মী হত্যার অন্যতম অভিযুক্ত আব্দুল মান্নান, যার ভাই চট্টগ্রামে ৩০ কেজি স্বর্ণ পাচারের সময় র্যাবের হাতে আটক হয়ে বর্তমানে জেলে আছে। এই মান্নানকে দিয়ে চোরাচালান ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে লোকমুখে কথিত আছে। আমরা এই অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।
এবিষয়ে এমপি আলী আজগর টগরের সাথে বাবরবার যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করেননি। এক পর্যায়ে তার এক সহকারী ফোন রিসিভ করে উনি নামাজে আছেন বলে জানান। পরবর্তীতে আবারো একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে কেউ ফোন রিসিভ করেননি বিধায় তার বক্তব্য সংযোজন করা সম্ভব হয়নি।
এমপি টগরকে নিয়ে দামুড়হুদা-জীবননগরের আওয়ামী পরিবারে অষন্তোষ বিরাজ করছে।
|