নিজস্ব প্রতিবেদক : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যখন দিশেহারা মানুষ তখন ব্যবসায়ীদের মুখে ভিন্ন সুর। তারা বলছেন, আগের মতো ব্যবসা নাই। বেচাকেনা কমে গেছে। কোনোরকমে ব্যবসা টিকে আছে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি নিয়েও চলছে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী এবং আমদানিকারক ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঠেলাঠেলি।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি ব্যবসায়ী ও ডিলাররা দাম বেশি নিচ্ছেন। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকরা বেশি নিচ্ছেন। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ঠিকমতো পণ্য দিচ্ছেন না। অন্যদিকে বড় ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা ঠিকমতো পণ্য সরবরাহ করলেও ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের এমন ঠেলাঠেলিতে চ্যাপ্টা হচ্ছেন ভোক্তারা।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ‘লাভের গুড়’ তাহলে কার থলিতে যাচ্ছে? কে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে? বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের নেতারা বলছেন, কিছু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় ভোক্তারা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেশের বাজারে চিনির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক দোকানে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে পাওয়া যাচ্ছে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি ১৩০-১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত ৬ এপ্রিল সরকার খোলা চিনির দাম প্রতি কেজিতে ৩ টাকা কমিয়ে ১০৪ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দামও প্রতি কেজিতে ৩ টাকা কমিয়ে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। অথচ দাম কমানোর পর উল্টো পথেই হাঁটছে চিনি।
রাজধানীর মুগদা এলাকার মুদি দোকানদার মিঠু মিয়া বলেন, আজ কয়দিন ধইরা চিনি বেচতে পারতাছি না। অর্ডার দিয়াও চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। আগে দুই বস্তা চিনি আনছিলাম, তাও রিসিট দেয় নাই। শুধু চিনিই নয়, সয়াবিন তেলও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। ১০ কার্টন অর্ডার দিলে দেয় ৩-৪ কার্টন। তাও লাভ খুবই কম। আমরা ব্যবসা করুম কেমনে?
আরেক ব্যবসায়ী ফরহাদ বলেন, অহন ইনভেস্ট বাড়লেও লাভ কমেছে। আগে দোকানে যে ইনভেস্ট ছিল সে টাকার মালামালে সবসময় দোকান ভরা থাকত। এখন দাম বাড়ার কারণে মালামাল দোকানে যেন অর্ধেক কমে গেছে। সব মালামাল রাখতে এবং দোকান ভরা রাখতে আবার ইনভেস্ট করেছি। বারবার তো সম্ভব না। খুবই সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, তেল, চিনি, সুজি, আটাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম আগে দাম কম থাকার পরও যে লাভ হতো এখন কোনো কোনো পণ্যে তার অর্ধেকও লাভ হয় না।
এক দোকানদার বলেন, এক বছর আগে ৭০-৮০ টাকায় আটা বিক্রি করে লাভ করতাম ১০-১৫ টাকা। এখন ১২০ টাকা বিক্রি করেও ১০ টাকা লাভ হয় না। তেল-চিনির কথা বাদই দিলাম। রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার মুদি ব্যবসায়ী সাগর হোসেন বলেন, ব্যবসা বন্ধ করার অবস্থায় আছি। দোকানে নতুন করে ৪০ হাজার টাকা ঢুকাইছি। তবুও দোকান খালি। একটা জিনিস আছে তো আরেকটা নাই। খুবই হিমশিম খাচ্ছি। জিনিসের দাম বাড়ছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রোডাক্টের দাম বাড়ে। এর সঙ্গে আমাদের লাভের পরিমাণ কমে যায়।
মাছ-মাংসের ব্যবসায়ীরাও জানান অস্বস্তির কথা। তারা বলছেন, বিক্রি আগের থেকে অনেক কমেছে। রাজধানীর মুগদা এলাকার মায়ের দোয়া পোলট্রি হাউজের একজন বলেন, আগে এক কেজি ব্রয়লার মুরগি কেনা পড়ত ১০০-১১০ টাকায়, বিক্রি করেছি ১৩০-১৪০ টাকায়। অথচ এখন এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি করেও ২০ টাকা লাভ করতে পারি না। আবার পরিবহন খরচ বাড়ছে। আরেক মুরগি দোকানদার বলেন, মানুষ আগে বড় মুরগি খুঁজত। এখন খোঁজে ছোট মুরগি। বেচাকেনাও অনেক কমে গেছে। আগে দিনে ৮০-১০০ কেজি মুরগি বিক্রি করেছি। অহন ৫০-৬০ কেজি বিক্রি করাও কঠিন হইয়া গেছে।
মাছ ব্যবসায়ীরাও বলছেন একই কথা। মালিবাগ বাজারে এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, কিছুদিন আগে যে মাছ ১০০-১১০ টাকায় কিনতাম সেটা অনায়াসে ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি করা যেত। কেজিতে ৪০-৫০ টাকা লাভ থাকত। এখন ১৫০-১৬০ টাকার ওপরে মাছ কিনে বিক্রি করতে হয় ১৮০-১৯০ টাকা। বেশি দাম হওয়ায় মানুষ মাছ কিনছে কম। অনেক সময় লোকসানে মাছ বিক্রি করতে হয়। পুঁজি বেশি খাটিয়েও লাভ কম, বেচা-বিক্রিও কম।
কাঁচা বাজারেও চলছে চরম অস্থিরতা। মাসের পর মাস কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করে কৃষক এক কেজি বেগুন বিক্রি করে ১৫-২০ টাকাও পায় না। অথচ কয়েক হাত বদল হয়ে রাজধানীতে ৫০-৬০ টাকা কেজি বেগুন কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। কৃষক টমেটো বিক্রি করে ১০ টাকারও কম দামে। সেই টমেটো খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন ৪০-৫০ টাকা। শুধু বেগুন কিংবা টমেটো নয়, সবজির ক্ষেত্রে একই অবস্থা। কৃষকের ঘরে যখন আলু নেই, তখন সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি। এক যুগের ব্যবধানে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। আড়াইশ টাকার গরুর মাংস এখন কিনতে হচ্ছে ৮০০ টাকা দিয়ে। ১০০-১১০ টাকার ব্রয়লার মুরগির দাম ২৩০-২৪০ টাকা। ১০০-১২০ টাকার মাছ এখন কিনতে হচ্ছে দুই-আড়াইশ টাকায়। ভরা মৌসুমেও সবজির দাম চড়া।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, কেউ না কেউ কারসাজি করছে। এতে কোনো সন্দেহ নাই। ধরেন দুই বছর আগে খোলা বাজারে চিনির দাম ছিল ৫০ টাকা বা তার কাছাকাছি। তখন ইন্টারন্যাশনাল বাজারের সাথে কেমন ব্যবধান ছিল সেটা চেক করলে দেখা যাবে আমাদের এখানে মুনাফার হিসাবটা বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফা করতে চায়। এক্ষেত্রে যারা বড় বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বা রিফাইনার কোম্পানি আছে তারাই বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করে।
বাজারে অস্থিরতার বিষয়টি স্বীকার করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও। তবে এসব বিষয়ে তাদের টিম নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, বাজারে অস্থিরতা দৃশ্যমান। বর্তমান বাজারে যে অস্থিরতা, এ ক্ষেত্রে মূলত সবাই দায়ী। খুচরা, ডিলার বা কোম্পানি- সবাই অস্থিরতা তৈরি করছে। বিশেষ করে চিনির দাম নিয়ে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়ে গেছে। প্রতি টনে ১৫০ ডলার বেড়েছে। রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটা চিঠিও দিয়েছে। চিনির দামের বিষয়ে গত বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্যারিফ কমিশনের একটা মিটিং হয়েছে। খুব শিগগিরিই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটা সিদ্ধান্ত আসবে।