ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুর গাইডলাইন ইসলাম দিয়েছে। আর আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম হলো ইসলাম। আমাদের এই সংক্ষিপ্ত জীবনে অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়, সম্পর্ক হয়। ভ্রাতৃত্ব বন্ধন এবং সম্পর্ক উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম হল ‘সালাম’। এই চমৎকার অভিবাদনটি অতি সহজেই অপরিচিত মানুষকে আপন করে নেয়।
‘সালাম’ শব্দটি আরবী এবং বাবে তাফয়ীল এর মাসদার। আল মুজামুল ওয়াফি এরাবিক-বাংলা অভিধান অনুযায়ী সালামের আভিধানিক অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সালাম ও অভিবাদন। অর্থাৎ আসসালামু আলাইকুম অর্থ হল: আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। শরীয়তের পরিভাষায় সালাম বলা হয়, একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিম এবং একজন মুসলিমা আরেকজন মুসলিমার সাথে সাক্ষাতের সময় যে বাক্য দ্বারা অভিবাদন জানায়, স্বাগত জানায় এবং শান্তি, নিরাপত্তা, কল্যাণ এবং দোয়া কামনা করে তাকেই আমরা সালাম বলে থাকি। মুসলিম সমাজে বহুল ব্যবহারিত অন্যান্য বাক্যের মধ্যে এটি অন্যতম।
সালামের প্রচলন: সালামের প্রচলন আদম (আ.)কে সৃষ্টির শুরু থেকে ছিল। এটি নতুন কোন আবিষ্কার না। হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তা’আলা আদম (আ.) কে সৃষ্টি করলেন। তার উচ্চতা ছিল ষাট হাত। তারপর আদম (আ.) কে নির্দেশ করলেন। তুমি ঐ সকল ফেরেশতাদের কাছে যাও এবং তাদেরকে সালাম কর। দেখ তারা কিভাবে উত্তর দেয়। সেটিই তোমার এবং তোমার সন্তানাদির অভিবাদন। তখন তিনি ফেরেশতাদেরকে সালাম করেন এবং তারা তার সালামের জবাব দেন।’ [ সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩২৬] সালাম অর্থাৎ অভিবাদন সকল ধর্মে থাকলেও সেটা তাদের নিজস্ব রীতিনীতি বা কৃষ্টি-কালচার, নিজেদের সভ্যতা অনুযায়ী ব্যবহার করে থাকে। যেমন: হিন্দু সম্প্রদায় পরস্পরে দেখা সাক্ষাতের সময় আদাব, নমস্কার ইত্যাদি বলে থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোতে হ্যালো বলে থাকে।
সালামের সঠিক ব্যবহার: সালাম দেওয়া সুন্নাত এবং সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। কেউ সালাম দিলে তার উত্তর না দিলে সে গুনাহগার হবে। সালামের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ উচ্চারণ হলো- আসসালামু আলাইকুম। আর পরিপূর্ণ জবাব হলো- ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। নিয়ম হলো- কথা বলার আগেই সালাম দেওয়া। প্রথমে সালাম না দিলে রাসূল (সা.) কথা বলার অনুমতি দিতে নিষেধ করেছেন। আমরা অনেকেই ভুলবশত এ বিষয়টি খেয়াল করতে পারিনা। আমরা কারো সাথে কথা বলার শুরুতে হ্যালো বলে আসসালামু আলাইকুম বলে থাকি। অথচ শুরুতেই সালাম দিয়ে কথা শুরু করতে হবে। বিভিন্ন অফিস বা কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে তথ্যের জন্য ফোন দিলে যারা ফোন রিসিভ করেন তাদের কেউ কেউ সালাম দেয় আবার কেউ কেউ সালাম দেয় না। আর যারা সালাম দেয় তারা ভুল উচ্চারণের মাধ্যমে আমাদের মৃত্যু কামনা করেন। কারণ সালামের উচ্চারণটা ঠিকঠাক উচ্চারণ না হলে শান্তির জায়গায় মৃত্যু কামনা অর্থ হয়ে যায়। নির্বিশেষে সকলকে বিকৃত সালাম ‘স্লামালাইকুম’ এর জায়গায় ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে শুদ্ধচর্চায় অভ্যস্ত হতে হবে।
কে কাকে সালাম দিবে: চলমান ব্যক্তি উপবিষ্টকে, আরোহী পদব্রজে ব্যক্তিকে, কম সংখ্যক লোক অধিক সংখ্যককে এবং ছোটরা বড়দেরকে সালাম দিবে। রাসূল (সাঃ)বলেছেন, ‘আরোহী পদচারীকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে’। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘ছোটরা বড়দেরকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে’। আমরা যদি আমাদের শ্রেণিকক্ষের দিকে খেয়াল করি তাহলে খেয়াল করতে পারব যে, স্যার যখন ক্লাসে প্রবেশ করেন তখন আমরা সবাই দাঁড়িয়ে স্যারকে সালাম দেই। অথচ এটাও ভুল চর্চা। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কম সংখ্যক লোক বেশি সংখ্যক লোককে সালাম দিবে। মুসলমান পুরুষের সাথে সালাম বিনিময়ের পাশাপাশি মুছাফাহা(পরস্পর হাত মিলানো) উত্তম। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘দু’জন মুসলিম একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে মুছাফাহা করলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়’। মুছাফাহার ক্ষেত্রে নিজের হাত আগেই টেনে নেওয়া সমীচিন নয়। হাদীছে এসেছে, ‘রাসূল (সা) যখন কারো সাথে মুছাফাহা করতেন, তখন ঐ ব্যক্তির হাত ছাড়তেন না, যতক্ষণ না সে রাসূল (সা:)-এর হাত ছেড়ে দিত’। উল্লেখ্য, মুছাফাহা এক হাতে অর্থাৎ দু’জনের দু’হাতে হবে। দু’জনের চার হাতে নয়। এটাও সমাজে বহুল প্রচলিত ভুল। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ভার্সিটিগুলোতে সহপাঠ থাকার কারণে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বলতে হয় যে, গায়র মাহরাম অর্থাৎ যাদের সাথে বিবাহ বৈধ এরূপ মহিলাদের সাথে মুছাফাহা করা হারাম। উমায়মা বিনতে রুকায়কা (রাঃ) বলেন, বায়‘আত হওয়ার উদ্দেশ্যে আমি কতক মহিলা সমভিব্যাহারে মহানবী (সাঃ) -এর নিকট উপস্থিত হ’লাম। তিনি আমাদের বলেন, যতদূর তোমাদের সামর্থ্যে ও শক্তিতে কুলায়। আমি মহিলাদের সাথে মুছাফাহা (করমর্দন) করি না’। অন্যত্র রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের কারো মাথায় লোহার হাতুড়ি দ্বারা আঘাত করা উত্তম, তার সাথে বৈধ নয় মহিলাকে স্পর্শ করা অপেক্ষা’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আলক্বামাহ বিনতু ওবায়দ হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘আমি নারীদের হাত স্পর্শ করি না’। অর্থাৎ গায়রে মাহরাম।
সালাম দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত: ‘সালাম’ নামক ইসলামিক অভিবাদনটির সামাজিক জীবনে ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা,ভালোবাসা। নিছক বাক্য হলেও সালাম এমন এক আকর্ষণীয় চুম্বক শক্তি যা মনের সকল প্রকার দূরত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ অনৈক্য দূর করে সবাইকে কাছে এনে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়। নবী করীম (সাঃ) শুধু নির্দেশই দেননি বরং নিজেও বাস্তব জীবনে এর উপর আমল করে উম্মতের সামনে এক অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি সবাইকে আগে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করতেন। হাদিসে এমন রয়েছে যে, অনেকেই তার আগে সালাম দেওয়ার জন্য চেষ্টায় থেকেও তাকে আগে সালাম দিতে পারতেন না। শুধু তাই নয় তিনি ছোটদেরকে শিক্ষার জন্য ছোটদেরকে সালাম দিতেন। নিচে কিছু সালামের গুরুত্ব ও ফযীলত নিয়ে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নছ উল্লেখ করা হলো: আল্লাহ তা`আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য কারও গৃহে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে ও তাদেরকে সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না।” (সূরা নূর, আয়াত ২৭)। তিনি অন্যত্র বলেছেন, “যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এ হবে আল্লাহর নিকট হতে কল্যাণময় ও পবিত্র অভিবাদন।” (সূরা নূর,আয়াত ৬১)
“যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয় (সালাম দেওয়া হয়), তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম অভিবাদন কর অথবা ওরই অনুরূপ কর।” (সূরা নিসা ,আয়াত ৮৬ )
সালামের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল’আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, ‘সর্বোত্তম ইসলামী কাজ কী?’ তিনি বললেন, “ক্ষুধার্তকে অন্নদান করবে এবং পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সকলকে (ব্যাপকভাবে) সালাম পেশ করবে।’’ (বুখারী-মুসলিম) আবূ ইউসুফ আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু ’আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ’’হে লোক সকল! তোমরা সালাম প্রচার কর, (ক্ষুধার্তকে) অন্নদান কর, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ এবং লোকে যখন (রাতে) ঘুমিয়ে থাকে, তখন তোমরা নামায পড়। তাহলে তোমরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’ (তিরমিযী ২৪৮৫)
-এ.এস.এম.মাহবুবুর রহমান শিক্ষার্থী, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়া সদস্য, তরুণ কলাম লেখক ফোরাম ইবি, শাখা
|