পবিত্র শা’বান মাস রজব এবং রমজান মাসের মধ্যে মধ্যস্থতা করে। শাবান মাস জেরুজালেম থেকে কা’বাতে কিবলা স্থানান্তরের সাক্ষী। আর আল্লাহ তায়ালা ‘নিসফে শাবানের রাত’ তথা শবে বরাতকে ক্ষমা ও রহমত দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন। শাবান মাসের ১৪ তারিখ মহিমান্বিত রাতকে ‘শবেবরাত’ বলা হয়। শবেবরাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলোঃ ‘শব’ শব্দটি ফার্সি। এর অর্থ রাত। ‘বারাআত’ শব্দটি আরবি। অর্থ : মুক্তি। তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত হলো ‘শবেবরাত’।
শা’বান মাস এমন একটি মাস যাতে সকল বান্দার আমলসমূহ মহান আল্লাহর কাছে উত্থাপিত হয়। প্রতিটি ঈমানদার ও মুসলমানদের জন্য মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার প্রস্তুতি গ্রহণের মাস হলো শাবান মাস। এই শাবান মাসের অবিচ্ছেদ্য একটি মহিমান্বিত রাত হচ্ছে চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত। যেই রাতটি এই বছর ৭ই মার্চে উদযাপন হতে যাচ্ছে। এই রাতে বান্দার গুনাহ মাফ করা হয়। অভাবীকে রিজিক দেওয়া হয়। বিপদমুক্ত করা হয় বিপদগ্রস্তকে।
পবিত্র কুরআন মাজিদে শবে বরাত সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন বর্ণনা নেই বলে, অনেক সাহাবী এবং তাবিয়ী হযরত ইকরামাহ (রহ) এর ব্যাক্তিগত অভিমতের সাথে একাত্মতা পোষণ করেন নি। মুফাস্সিরগণ সুরা দুখানের ৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বলতে লাইলাতুল কদরকে বুঝানো হয়েছে বলে হযরত ইকরিমাহর মত বাতিল এবং অন্যান্য সাহাবী ও তাবিয়ীর মতকে গ্রহণ করেছেন। প্রিয়নবীর অসংখ্য হাদিস দ্বারা শবে বরাতের ফজিলত, গুরুত্ব ও মহত্ত্ব প্রমাণিত। কিন্তু বিভিন্ন মতামত এবং দলিল পেশ করে শবে বরাতে ‘কুরআন নাযিলের’ রাত দাবি করা নিছক ভিত্তিহীন। আয়াতে কারীমার মধ্যে যে ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ তথা বরকতময় রজনীর উল্লেখ করা হয়েছে সেটি দ্বারা কেবলমাত্র লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে তাফসির গ্রন্থের অধ্যয়ন করা একান্ত জরুরি।
‘শবেবরাতকে হাদিসের পরিভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়। এই রাতে আল্লাহতায়ালা সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আসমানে নেমে আসেন। বান্দাকে ডাকতে থাকেন। বান্দার যাবতীয় প্রয়োজন আল্লাহর কাছে পেশ করার আহ্বান করেন।
এই রাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে রয়েছে বেশ কিছু সহিহ হাদিস। তা ছাড়া এ রাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে রয়েছে বিশিষ্ট ইমামগণের নির্ভরযোগ্য বহু বক্তব্য। হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “শা‘বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। সে রাতে তিনি মুশরিক এবং অন্য ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষক ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।”ইবনে মাজাহ, আস সুনান ১/৪৪৫, মুসনাদে বাজজার- ৮০
এ বিষয়ে হাদিসে রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেনঃ ‘মানুষদের আমল প্রতি সপ্তাহে দুবার পেশ করা হয়, প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার। তখন সকল মুমিন বান্দাহকে ক্ষমা করা হয়, কেবলমাত্র যে বান্দার সাথে তার ভাইয়ের বিদ্বেষ শত্রুতা আছে সে ব্যক্তি ব্যতীত। বলে দেওয়া হয়, এরা যতক্ষণ পর্যন্ত ফিরে না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত এদেরকে বঞ্চিত করা হয়। সহিহ মুসলিম ৪/১৯৮৮। হিংসা বিদ্বেষের ভয়ংকর ছোবল পৃথিবীর ইতিহাসে ইহুদি খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতির ধ্বংসের একমাত্র প্রধান কারণ ছিল।
অন্যত্র মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “শা‘বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। সে রাতে তিনি মুশরিক এবং উম্মতে বিভেদ সৃষ্টিকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।” [সহিহ ইবনে হিব্বান- ৫৬৬৫; শুআবুল ইমান, বায়হাকি- ৩৮৩৩]
অন্যত্র ইবনে উমর (রা.) বলেন, “পাঁচটি রাত এমন রয়েছে, যে রাতের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।— ১. জুমু‘আর রাত। ২. রজব মাসের প্রথম রাত। ৩. শা‘বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত (শবে বরাত)। ৪. ইদুল ফিতরের রাত। ৫. ইদুল আজহার রাত।” [মুসান্নাফে আবদুর রাজজাক- ৭৯২৭]
★শবে বরাতে আমল করার ব্যাপারে কয়েকটি যয়িফ হাদিস থেকে তিনটি আমল জানা যায়ঃ প্রথমত কবর যিয়ারত করা, দোয়া করা এবং নফল নামাজ আদায় করা।
★শবে বরাতের নামাজ— এই ‘শবে বরাত’ উপলক্ষে বিশেষ নামাজ বা নামাজের বিভিন্ন রাকাত সংখ্যা, বিশেষ সুরা তেলাওত করা সম্পর্কিত কোনো সহিহ হাদিস নেই। কিন্তু ইমাম ইবনে মাজাহ হযরত আলী রাঃ এর সুত্রে একটি হাদিস সংকলন করেছেন, যাতে উল্লেখ আছে যে ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাতের বেলায় সালাত ও দোয়ায় দন্ডায়মান থাকো এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। ইবনে মাজাহ-১৩৮৮ নং হাদিস।
★শবে বরাতের রোজা— ‘শবে বরাত’ উপলক্ষে বিশেষ কোনো রোজা নেই। এই উপলক্ষে রোজা রাখা সম্পর্কিত হাদিস সহিহ নয়; দুর্বল। তবে এমনিতে কেউ চাইলে পরের দিন অর্থাৎ চন্দ্র মাসের ১৫ তারিখ ‘আইয়্যামে বিজ’-এর রোজা রাখতে পারে। (‘আইয়্যামে বিজ’ অর্থ ‘উজ্জ্বল রাতের দিনগুলো’)। চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে ‘আইয়্যামে বিজ’ বলা হয়। হজরত আবু জর ও কাতাদা ইবনে মিলহান (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আইয়্যামে বিজ তথা শুভ্রপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে প্রতি মাসে এই তিন দিন রোজা রাখতে বলেছিলেন।”) [জামে তিরমিজি- ৭৬১; সুনানে নাসায়ি- ৪/২২৩-২২৪; সুনানে ইবনে মাজাহ- ১৭০৭-১৭০৮, সুনানে আবু দাউদ- ২৪৪৯]
শবে বরাতে একাকী ইবাদতসমূহ- চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত তথা শবে বরাতে একাকী ইবাদত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তাই রাতে আমরা যত ইচ্ছা তত, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নামাজ পড়তে পারি, কুরআন কারিম তেলাওয়াতসহ বিভিন্ন সহিহ জিকির-আজকার, ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিলে মশগুল থাকতে পারি এবং পরের দিন তথা ১৫ তারিখ দিনে ‘আইয়্যামে বিজ’-এর রোজা রাখতে পারি।
শবে বরাত উপলক্ষে কবর জিয়ারত- হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, “এক রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি হারিয়ে ফেললাম। আমি তাঁর খোঁজে বের হলাম। জান্নাতুল বাকিতে (সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ কবরস্থান) তাঁকে পেলাম। তিনি বললেন, ‘তুমি কি ভয় করছো যে, মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলের ওপর অত্যাচার করেছেন?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি ধারণা করেছি যে, আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে এসেছেন।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের বকরি-লোমের সংখ্যার চেয়ে বেশি মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দেন।” [তিরমিজি- ৭৩৯; ইবনে মাজাহ- ১৩৮৯]
আমাদের অনেকেই শবে বরাতে দলবেঁধে কবর জিয়ারত করেন। কিন্তু কোথাও এর ফজিলত সংক্রান্ত বর্ণনা নেই। এমনিতে যেকোনো সময় এবং শবে বরাতে শরিয়তসিদ্ধ পন্থায় কবর জিয়ারত করতে পারি আমরা। কিন্তু শবে বরাতের বিশেষ আমল হিসেবে জিয়ারত করা সম্পূর্ণ অবৈধ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে না বলে, একাকী, সংগোপনে জান্নাতুল বাকিতে গিয়েছিলেন। কাউকে যাওয়ার কথা বলেননি এবং তিনি নিজেও কাউকে নিয়ে যাননি। পুরো বিষয়টি হাদিস থেকে সহজেই অনুমেয় হয়। আমাদের জন্য কর্তব্য হলো, শরিয়তসিদ্ধ পন্থায় জীবনযাপন করা।
★মধ্য শাবানের দোয়া -‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি আগুনের ফিতনা থেকে, আগুনের আযাব থেকে, কবরের ফিতনা থেকে, কবরের আযাব থেকে, সম্পদের পরীক্ষার অনিষ্ট থেকে এবং জাহান্নামের পরীক্ষার অনিষ্ট থেকে। দারিদ্রতা। হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি খ্রীষ্টশত্রুর পরীক্ষার অনিষ্ট থেকে। সাদা ময়লা থেকে এবং আমাকে আমার পাপ থেকে দূরে সরিয়ে দাও যেমন তুমি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে দূরত্ব রেখেছ, হে আল্লাহ, আমি অলসতা থেকে তোমার আশ্রয় চাই।’
শবে বরাত হলো ইবাদাত বন্দেগি ও দুয়া ক্রন্দনের রাত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, যে আমরা এই মহিমান্বিত রাতকে বিভিন্ন ধরণের নামী-দামী খাবার দাবার, উৎসব ও আনন্দের রাত বানিয়ে ফেলেছি। আমরা মনে করি, এই রাতে যতবেশি হালুয়া রুটি গোস্ত পোলাও খাওয়া যায় ততই বেশি সাওয়াব আমাদের আমলনামায় যুক্ত হয়। এমনকি রাতের বেলায় মসজিদ, মাদ্রাসায়, খানকা, ঈদগাহে আলোকসজ্জা, কবরে কিংবা মাজারে মোমবাতি আগরবাতি জ্বালানো, বাজি ফুটানো, মিলাদ কিয়াম করে সিন্নি বিতরণ করা নিছক কল্পনাপ্রসূত বিবেকহীন কাজ ব্যতীত অন্য কিছুই নয়।
সুতরাং আমাদের উচিত, শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান অর্জন করা এবং শিরক বিদয়াতমুক্ত আমল উপার্জন করা। মহান আল্লাহর একান্ত মর্জি কামনা করছি যে, তিনি যেন লাইলাতুল বরাতকে আমাদের মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে বশীভূত করে দেন, আমাদের পাপরাশি মোচন করে দেন। আমিন। ইয়ারব্বাল আলামিন।
মোঃ ইয়াছিন আরাফাত আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ। অনার্স ১ম বর্ষ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া