বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় হলো দারিদ্র্য। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার এর পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত পরিভাষা। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের বড় একটা অংশ প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের একমাত্র ভরসা বেসরকারি ঋণদাতা সংস্থা। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করে কেউ উপকৃত হয়েছে কেউবা সব হারিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে। তবে এনজিওগুলো পরিবারের স্বাস্থ্য, সন্তানের শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও সৌচাগার ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। কিছু ভালো দিক থাকলেও এনজিও নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যবিমোচন করে না বরং সামন্ত সমাজের ভূমিদাসের মতো এ যুগের মানুষকে গ্রামীণ ব্যাংক এক ধরনের ঋণদাসে পরিণত করছে। মানুষের দারিদ্র্যতাকে কাজে লাগিয়ে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে লাভজনক ব্যবসা পরিচালনা করছে এসব ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। দারিদ্র্য বিমোচনে এনজিওর ভূমিকা নিয়ে মিশ্র মতামত দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা, কেউ কেউ বলছেন কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। আবার কেউ বলছেন ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ ঋণ দারিদ্র্য দূরীকরণে পুরোপুরি ব্যর্থ, এই ঋণ নিয়ে অনেকেই সর্বস্ব হারিয়েছেন; কেউ কেউ আবার ঋণের বোঝা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ৬৭শতাংশই ব্যায় করে অলাভজনক/ অনুৎপাদনশীল খাতে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক কোন ভূমিকাই পালন করে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ঊট) আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, হতদরিদ্র ব্যাক্তিদের (৫০-৭৫)শতাংশই ঋণগ্রস্থ। বেসরকারি সংস্থাগুলো মিথ্যা প্রলোভন ও স্বপ্ন দেখিয়ে দরিদ্র্য জনগণকে ঋণ নিতে আগ্রহী করে তুলে। কিন্তু গ্রাহকেরা ঋণের টাকা কোথায় খরছ করছে তার খবর রাখে না কেউই। অনেকে ঋণের টাকায় ধারদেনা শোধ করে, আসবাবপত্র কিনে, যৌতুক দেয়, ঘর মেরামত করে, আবার অনেকের স্বামী নেশা করে ঋণের টাকা নষ্ট করে ফেলে। যার ফলে কোন আয় তো নয়ই বরং আরও উচ্চ সুদের বেড়াজালে আটকা পড়ে সর্বশান্ত হয়ে পরছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার (২০-৪৪)শতাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ক্ষুদ্রঋণ যদি সফল হতো তবে আজও কেন ৭ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে ? দেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সুচনা হয় আশির দশকে। ৪০বছর পর ও এমন কোন প্রমাণ নেই, যাতে মনে হতে পারে ক্ষুদ্রঋণ মানুষকে দারিদ্র্যতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। তবে এই চিত্র আমরা দেখেছি যারা দারিদ্র্য বিমোচনে মাঠে নেমেছেন তারা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ঋণ গ্রহীতারা ঋণকৃত টাকা কোন উৎপাদনশীল খাতে লাগাতে পারেনা যার ফলে আয় হয়না। আর আয় না হলে ঋণ পরিশোধ করবেই বা কিভাবে? আবার ঋণ গ্রহীতারা ঋণ গ্রহনের একমাস বা এক সপ্তাহ পরই কিস্তি শুরু হয়। এখন প্রশ্ন হলো ঋণকৃত টাকা তো মাত্রই বিনিয়োগ হলো লাভ আসতে সময় লাগবে। তাহলে এমতাবস্থায় কিস্তি কিভাবে পরিশোধ করবে? আবার সঞ্চয় এর কথা বলে এরা কিছু টাকা কেটে রেখে দেয় যা পরে ফেরত দিতে চায়না। ১০ হাজার টাকা ঋণ দিলে ঋণ উঠানোর সময় ৫০০ টাকা কেটে রাখে সঞ্চয় খাতে। কোন কোন এনজিও গ্রাহকের চাহিদা ছাড়াই বীজ, মুরগির বাচ্চা, গাছের চারা কিনতে বাধ্য করে। এতকিছু কাটার পর বাকি টাকা বেশির ভাগ সময়ই আয় বৃদ্ধি কার্যক্রমে সফল হয়না।শুধু ঋণের বোঝাই বেড়ে যায়। অনেক ঋণ গ্রহীতার শেষ পর্যন্ত ভিটেমাটি বিক্রি করেও ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি মেলেনা। কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ঘরের টিন খুলে নিয়ে যায়, আসবাবপত্র বিক্রি করে দেয়, অপমান অপদস্ত করে এনজিও কর্মীরা যা সইতে না পেরে অনেকে আআত্নহত্যার পথ বেচে নেয়। দারিদ্র্যতার দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী পুরুষেরা আশ্রয় নেয় এনজিওগুলোতে কিন্তু মুক্তি তো মেলে না। তাহলে এনজিওর সুফল কোথায়?
কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে হয়তো সুফল বয়ে আনা যেতে পারে, যেমন সুদের হার কমানো, উৎপাদন খাতে ব্যয় হচ্ছে কিনা তদারকি করা, নগদ টাকা না দিয়ে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সরঞ্জাম কিনে দেয়া এবং প্রশিক্ষণ দেয়া (মহিলাদের সেলাই মেশিন, পুরুষদের রিকশা, অটো ইত্যাদি), স্বল্পমেয়াদি ঋণকে দীর্ঘমেয়াদী করা। ক্ষুদ্রঋণ মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে, তবে ক্ষুদ্রঋণ প্রক্রিয়ার ধরন, পরিধি ও ভারসাম্য বিষয়ে গবেষণা অপর্যাপ্ত ও অসম্পূর্ণ। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে পরিবর্তন আনা দরকার নচেৎ এটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কোন কাজেই আসবে না।
লেখক: জান্নাতুল নাইম মিশি শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।