সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসের সাজাহান কবির ও দালালদের দৌরাত্মে অতিষ্ট মানুষ
2, October, 2022, 3:14:32:PM
ফারুক রহমান, সাতক্ষীরা: পত্রিকায় দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী সাজাহান কবিরের দৌঁড়ঝাপ শুরু হয়ে গেছে। সাজাহান কবির সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসে যোগদানের পর হতে দালালদের স্বর্গরাজ্য আর দূর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। লাইনের (দালাল) মাধ্যমে ১৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা দিলে ত্রুটিপূর্ণ কাগজপত্র দিয়েও দ্রুততম সময়ে পাসপোর্ট তৈরি করা যাচ্ছে এই অফিস থেকে। সম্প্রতি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ সাজাহান কবিরের দূর্নতির সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশ না করার জন্য জোর সুপারিশ করেছেন। এছাড়া দালালরা বিভিন্ন পর্যায় থেকে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য তদবির করছে। সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসের নিউজ বন্ধ করতে নানামুখি তৎপরতা দেখা গেছে।
সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিস বর্তমানে দালালের বাইরে কোন কাগপজত্র জমা দেওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমান সহকারি পরিচালক সাজাহান কবির দালাল ছাড়া কারও কোনে ফোন রিসিভ করেন না। এই অফিসের দালালরা বর্তমানে দলবেঁধে দূর্নীতি আড়াল করতে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাজাহান কবিরের পক্ষে বিভিন্ন পোস্ট দিচ্ছে। সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসে সকাল থেকে দালালের সিন্ডিকেট পরিচালিত হচ্ছে সহকারি পরিচালক সাজাহান কবিরের নেতৃত্বে।
সরজমিনে একটানা তিনদিন সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিস কম্পাউন্ডে অবস্থান করে পাসপোর্টের জন্য কাগজপত্র জমা দিতে আসা বেশ কয়েকজনের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলে জানা গেছে, এখানে দালাল ছাড়া কোন কাজ হয় না। কারও পাসপোর্টে কোনো প্রকার সংশোধনী থাকলে তার জন্য ব্যয় করতে হয় পাঁচ থেকে সাত অতিরিক্তি টাকা। সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিস শুরু হয় বর্তমান নতুন সময় অনুযায়ী ৮টায়। অফিস শুরু হলে প্রথমে কোন দালালের কয়টি পাসপোর্ট ছাড়া হবে, কোন দালালের কয়টি পাসপোর্ট এন্ট্র্রি হবে, কোন দালালের কয়’টি পাসপোর্টের ছবি তোলা হবে। এসব ঠিক হয় পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকের রুমে দালাল চক্রের প্রতিনিধি ও অফিসের নির্ধারিত কর্মচারীর আলোচনার মাধ্যমে। দৈনিক পাসপোর্ট প্রতি কমিশন ১০০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ হয়। পাসপোর্টের সংখ্যা কমবেশি হলে কমিশন ওঠানামা করে।
গত বৃহস্পতিবার সরজমিনে সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা গেছে দালাল বা নির্ধারিত কম্পিউটারের দোকান ছাড়া সরাসরি কেউ ফরম জমা দিতে গেলে সেই ফরমের নানারকম ভুলত্রুটি বের করে আবেদনকারীকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। আবার ওই একই ফরম দালালের মাধ্যমে জমা দিলে সাথেই জমা নেওয়া হচ্ছে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মচারী (পদবি ডিআইপি) বলেন, দৈনিক চার শতাধিক ফরম জমা হয়। দালাল ছাড়া সরাসরি কোন ফরম জমা দিতে গেলেই তৈরি হয় নানারকম বিপত্তি। দালালের এসএমএস ছাড়া ফরম জমা দিতে গেলে ফরমে ভুলত্রুটি বের করে আবেদনকারীকে ঝামেলা পোহাতে হয়। আসতে হয় বারবার। যোকোন ফরম দালালের মাধ্যমে জমা দিলে সব ভুল হালেও মুর্হূর্তে জমা হয় নির্দিষ্ট মডিউলে।
তিনি আরও বলেন, পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা দেওয়ার মডিউল দুটি। আবেদনকারীদের ফরম জমা দেওয়ার লাইন একই কিন্তু কম্পিউটার এন্ট্রির মডিউল আলাদা। একটা মডিউলে জমা হয় সম্পূর্ণ সহকারি পরিচালক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দালাল চক্রের এসএমএস পাওয়া তালিকা ধরে। অন্য মডিউলে এক থেকে তিন হাজার টাকা বাচানোর জন্য বারবার ঝাড়–দার লাভলুর (আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ) মাধ্যমে। শুধুমাত্র এসএমএস পাওয়া ফরম নিদিষ্ট সময়ে স্ক্যানিং করে ঢাকায় পাঠানো হয়। অসুস্থ মানুষের পাসপোর্ট আবেদন ফরমও দীর্ঘদিন পড়ে থাকে অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায়। সংশোধনের জন্য আসলে লাভলু ও আমিনুরের (ডিআইপি) কাজে তাদের যাওয়া লাগবেই। নাম সংশোধনে আট হাজার। বয়স সংশোধনে বছর প্রতি আট হাজার। পাঁচ বছর হলে ৪০ হাজার টাকা ঢাকায় পাঠানোর কথা বলে পাসপোর্টধারীদের কাছ থেকে নেয়া হয়। শাজাহান কবির ঝাড়ুদার লাভলুর মাধ্যমে জেলাব্যাপী গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী দালাল চক্র।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে ভুক্তভোগী কয়েকজন জানিয়েছেন, বর্তমান সহকারী পরিচালক সাজাহান কবির যোগদানের পর থেকে সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালাল চক্র। এই চক্রের মাধ্যমে প্রতিদিন সহকারী পরিচালক বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক সরাসরি দূর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ায় জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসহায় দরিদ্র সাধারণ মানুষ পাসপোর্টের জন্য ফরম জমা দিতে এসে নিয়মিত হয়রানর শিকার হচ্ছে। তাদের পাসপোর্ট জরুরি দরকার হওয়ায় কেউ অভিযোগ করতে সাহস পায় না। সাধারণত জরুরি চিকিৎসা, শিক্ষার্থীদের ভিসা সংক্রান্ত বিষয়, অনেকে বিদেশে ব্যবসার কাজে এবং জরুরি বিদেশ ভ্রমণের মতো বিষয় সহকারী পরিচালকের দূর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারছে না। এদিকে, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাসপোর্টের জন্য কাগজপত্র জমা দিতে আসা শ্যামনগরের আবদুল জলিল কয়াল, রফিকুল ইসলাম, আশাশুনির রহিমা বেগম, সদর উপজেলার শেখ জালাল উদ্দীনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা কোন না কোন দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করতে এসেছেন। তাদের অধিকাংশের দাবি দালালের মাধ্যমে না আসলে এখানে পাসপোর্ট করা যায় না। হয় কাগজপত্রে ত্রুটি বের হয়, না হয় দীর্ঘদিন দেরিহ য়। সেক্ষেত্রে তাদের গুনতে হয় অতিরিক্ত তিন থেকে চার হাজার টাকা।
এসব দূর্নীতি, অনিয়মের বিষয়ে জানতে সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক সাজাহান কবিরের কাছে সরাসরি তার অফিসে যোগাযোগ করা হলে তিনি কিছু কাগজপত্রের বিষয় এড়িয়ে যান এবং কিছু বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। প্রতিদিন চার’শ ফরম জমার হওয়ার তথ্য স্বীকার করে অন্য বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, আপনারা শুধু এগুলো দেখতে পান? এখানে জনবল সংকট সেটা দেখেন না। এসএমএস`র বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।