সুমাইয়া আক্তার
একটা সময় ছিল যখন আমাদের জীবনে পড়াশোনাটাই মূল লক্ষ্য ছিল না। শৈশবের দুরন্তপনায় যখন আমরা মেতে থাকতাম। জীবনে কোন কিছুর প্রতি আমরা কোন চাপ নিতাম না। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে খেলার মাঠে দৌড়। হাসি তামাশা আর রংধনুর মতোই রঙিন জীবন বেনীআসহকলা`র মত পার করতাম আমরা।
আমাদের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে যেন বদলে যেতে থাকলো সেই দুরন্তপনার শৈশব। পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে বর্তমান যুগের শিশুদের শৈশবে। ভিন্নতা দেখা দিয়েছে আমাদের সে যুগ আর বর্তমান যুগের শিশুদের জীবন যাপনে।
বর্তমান যুগের শিশুদের জন্মের পরই কেড়ে নেওয়া হয় তাদের সুন্দর শৈশবটাকে। আর নামিয়ে দেয়া হয় এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। শৈশবের মাঠে হেসেখেলে পার করার দিনগুলোতে তাদের ক্লাস, কোচিং আর প্রাইভেট টিউটরের কাছে উৎসর্গ করতে হয়। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তাদের নামিয়ে দিয়ে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত করছি তাদের সুস্থ স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবনটাকে। জীবনে আসলে পড়ালেখাই মুখ্য বিষয় না। পড়াশোনার পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের ও যথেষ্ট দরকার আছে। মানসিক বিকাশের জন্য চিত্তবিনোদন অপরিহার্য। কিন্তু বর্তমান যুগের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সে সময়টা দিতে চান না। জন্মের তিন বছর পরই তাদের পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হয় এক গাদা বই। যার ভার বহন করতে গিয়ে সোনালি শৈশবটাকে মলিন করে তুলতে হচ্ছে ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুদেরকে।
জিপিএ- ৫ নামক এক অসুস্থ সফলতার দিকে হেঁটে চলেছে বর্তমান সমাজ। এখনকার যুগের বাবা-মায়েদের নাকি সম্মান জড়িয়ে থাকে সন্তানদের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ রেজাল্টের উপর। কোনোভাবে যদি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারে তাহলে শুরু হয় কোমলমতি শিশুদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। আর এগুলো কারা করে? তাদের বাবা-মায়েরা-ই। বর্তমান যুগের বাবা-মায়েরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতা মানতে চান না। তারা চান এমন সন্তান যারা সারা দিন-রাত পড়ার টেবিলে বসে পড়ুক। প্রত্যেক বাবা -মা-ই চায় তাদের সন্তান ক্লাসে ফার্স্ট হোক। প্রত্যেকটি পাবলিক পরীক্ষায় যেন জিপিএ-৫ পেয়ে উর্ত্তীণ হয়। আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থীকে সাধারণ বৃত্তি কেন পেল, ট্যালেন্টপুলে কেন পেল না তা নিয়েও অনেক অপমান অত্যাচার করা হয়। প্রায়শই খবরের কাগজে দেখা মিলে এমন কিছু মর্মান্তিক ঘটনার যেখানে "জিপিএ-৫ না পাওয়ায় স্কুল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা" এ ধরনের শিরোনাম দেখা যায়।
এই জিপিএ-৫ এর জন্য একের পর এক কোচিং, প্রাইভেট, এক্সট্রা ক্লাসে পাঠানো হয় তাদের। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জীবনে ও অবসর থাকে। কিন্তু এখনকার যুগের বাচ্চাদের জীবনে কোনো অবসর থাকে না। খেলাধুলা, ব্যায়াম, ঘুরাঘুরি এগুলো এখনকার বাবা-মাদের মতে সময় নষ্ট। আর এসব করে সময় নষ্ট করার চেয়ে তারা এখন তাদের সন্তানকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে রাখতে চায়। তাদের মতে এতে তাদের সন্তান সবার চেয়ে এগিয়ে যাবে। কিন্তু বোকা বাবা-মা একবারও ভেবে দেখে না যে তারা আসলে এভাবে তাদের সন্তানের জীবন ও ভবিষ্যত নষ্ট করছে। ধ্বংস করছে শিশুদের শৈশব, কৈশোরের রঙিন দিনগুলো। বাধা সৃষ্টি করছে শিশুদের মানসিক বিকাশে। জিপিএ-৫ নামক এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলতে থাকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। বাবা-মায়েরা সন্তানদের এক্সট্রা ক্লাস, কোচিং, প্রাইভেট এর জন্য দিয়ে তাদের দিনের বাকি অংশ কেড়ে নেন। এমনকি রাতের বেলায় ও অনেকে তাদের প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ান। যে কোনো মূল্যেই চাই এক হালি জিপিএ-৫।
উচ্চমাধ্যমিকের পর জিপিএ-৫ এর সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা-ই শেষ নয়। এরপর তাদের সম্মুখীন হতে হয় আরো বড় যুদ্ধের। যার নাম ভর্তি যুদ্ধ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিট সে যেন সোনার হরিণ।দিন দিন এই প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সারা বাংলাদেশের সকল সরকারি মেডিক্যাল, সরকারি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে মাত্র ৬৪,০০০ আসন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের তুলনায় আসন সংখ্যা খুবই নগণ্য। আর এই সীমিত আসন দখল করার জন্য প্রতিবছর ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী। উচ্চমাধ্যমিকের পর ছুটি কাটাবে তো দূরের কথা কলেজে পড়াকালীন সময়েই একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের ভর্তি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতে হয়। এইচএসসির পর তা শুরু হয় পুরাদমে। একের পর এক প্রাইভেট, কোচিং, বই আর এক গাদা শীটের মাঝেই ডুবে থাকতে হয় সারাদিন। কঠোর পরিশ্রম করার পরও অনেক শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না।
জীবন দিয়ে পড়াশোনা করেও অনেক সময় সবার ভাগ্য সহায় হয় না। যেহেতু শিক্ষার্থীদের তুলনায় আসন সংখ্যা খুবই কম তাই সবাই পরিশ্রম করলেও চান্স পাবে না। কিন্তু এটা আমাদের সমাজ, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন মানতে চায় না। তাদের মতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে তার কোনো কোয়ালিটিই নাই। আর যদি শিক্ষার্থী সায়েন্স ব্যাকরাউন্ডের হয় তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সে যত ভালো সাবজেক্ট নিয়েই পড়ুক না কেন সমাজ তাকে মেডিক্যাল, বুয়েট নিয়ে প্রশ্ন করবেই। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা যেন মুখিয়ে-ই থাকে কবে রেজাল্ট বের হবে আর পাশের বাসার ছেলে/মেয়েটা কি রেজাল্ট করলো তা জানতে হবে। আর এসব আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে নিজেদের সম্মান বজায় রাখতে বাবা-মায়েরা এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বলি দেন তাদের কোমলমতি সন্তানদের।
সত্যি বলতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আহামরি কোনো কিছু না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেই যদি জীবনে সফল হওয়া যেত তাহলে দুদিন পর পর ঢাবি, রাবি, জাবি, ইবি, জবি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর শোনা যেত না।
প্রাইভেট ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়েও বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থী উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্কিল ও টেকনোলজির দিক দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। এমনকি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ব্রাক ইউনিভার্সিটিসহ আরো অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে।
এ তো গেল শিক্ষার প্রতিযোগিতা এরপর আসে চাকরির প্রতিযোগিতা। আমার মনে পড়ে আমি যখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই তখনই আমার বড় কাকা আমাকে বলেছিলেন "তোকে কিন্তু বিসিএস দিতেই হবে" বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগেই আমার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিসিএসই আমার জীবনের লক্ষ্য। ভার্সিটিতে প্রায়ই ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলেন যে আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে এত বছরেও নাকি কোনো বিসিএস ক্যাডার বের হতে পারেনি।এ কথাগুলো তারা অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই বলেন এবং আশা করেন আমরা যেন বিসিএসে সফলতা অর্জন করে তাদের সম্মান বৃদ্ধি করতে পারি। তখন আমার বলতে খুব ইচ্ছা করে যে, স্যার/ম্যাম আপনারা শুধু এটাই দেখলেন যে আমাদের বিভাগ থেকে কেউ বিসিএস ক্যাডার হতে পারেনি কিন্তু এটা দেখলেন না যে এ বিভাগের কত শিক্ষার্থী কত বড় বড় জায়গায় দায়িত্বরত আছে। তাদের মতে বিসিএসই যেন চূড়ান্ত সফলতা। এছাড়া যেন আর কোনো চাকরির কোনো দাম নেই। বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন একেকটা বিসিএস ক্যাডার গড়ার কারখানা হয়ে উঠেছে।
বর্তমান যুগের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা জীবনকে উপভোগ করার বদলে প্রথম বর্ষ থেকেই হাতে এমপি থ্রী নিয়ে ঘুরছে। মনে পড়ে এপিজে আবুল কালাম স্যারের সেই বিখ্যাত উক্তি, "যতদিন শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু চাকরি পাওয়া হবে ততদিন সমাজে চাকররা জন্মাবে মালিক নয়।" সত্যিই এখন আমরা ভুলে গেছি যে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন, মনুষত্ববোধ জাগ্রতকরণ, সুনাগরিক হওয়া। তা ভুলে আমরা এখন মুখস্থবিদ্যার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বাঁচাতে আমাদের সকলের এখনই সোচ্চার হওয়া উচিত। জীবন তো একটাই সে এক জীবনকে নরকের বদলে উপভোগ্য করে তুলতে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। শিশুদের পর্যাপ্ত মানসিক বিকাশের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত খেলাধুলা, শরীরচর্চা ও ভ্রমণে সময় দেওয়া উচিত। শিশুদের উপর কোন চাপ সৃষ্টি না করে তাদের মতামতকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া উচিত। তবেই ঘটবে মানসিক বিকাশ জাগৃত হবে মনুষ্যত্ববোধ এবং জীবন হবে সুন্দর ও উপভোগময়।
লেখক: সুমাইয়া আক্তার শিক্ষার্থী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
|