নিজস্ব প্রতিবেদক বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশি ঋণই এখন ভরসা। তাই এই ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত তিন বছরে বিদেশ থেকে তিন লাখ ৩৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে আগামী দুই অর্থবছরে ব্যয় হবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। ডলারের অঙ্কে প্রতি বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি।
অর্থ বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এর পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ২৬ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণ নেওয়ার টার্গেট রয়েছে ৯৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাজেটে মোট অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণের অংশ মধ্যমেয়াদে ধীরে ধীরে কমবে এবং বৈদেশিক অর্থায়নের হার বাড়বে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন মোট অর্থায়নের ৪৫ শতাংশে পৌঁছাবে। আগামী তিন বছরে বৈদেশিক উৎস থেকে অনুদানের পরিমাণ সামান্য প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যাবে। অন্যদিকে একই সময়ে বার্ষিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ক্রমেই বাড়তে থাকবে।
চলতি অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যা হবে
যথাক্রমে ২০ হাজার ৪৬ কোটি টাকা এবং ২২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। তবে বাজেটে বিদেশি ঋণের প্রক্ষেপণ যা-ই ধরা হোক, সেই হারে কিন্তু কখনো ঋণ পাওয়া সম্ভব হয়নি। যেমন সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি নিট ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে তা সংশোধন করে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরা হয় ৭৭ হাজার ২০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, বিদেশি ঋণের জন্য এখন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এই দুই সংস্থা থেকে উল্লেখযোগ্য ঋণ পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। যেমন আইএমএফের কাছ থেকে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট স্থিতিশীল রাখতে আগামী তিন অর্থবছরে ৪৫০ কোটি ডলার পাওয়া যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের কাছেও বাজেট সহায়তায় ঋণ চাওয়া হবে। অনেকটা স্বল্প সুদে এ ঋণ পেলে ঘাটতি বাজেট বাস্তবায়নে সুবিধা হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিরাপদ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। সেটা নির্ভর করছে এসব ঋণ কতটা দ্রুত সময়ে পাওয়া যায় তার ওপর।
এদিকে এখন স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগ বলছে, বাংলাদেশ বহু বছর ধরে স্বল্প সুদে নমনীয় শর্তে (কনসেশনাল) বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার সুবিধা ভোগ করে আসছিল। তবে ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ এখন ব্লেন্ডেড শর্তে বেশির ভাগ ঋণ নিচ্ছে, যার সুদের হার ও অন্যান্য শর্ত নমনীয় ঋণের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও আন্তর্জাতিক ঋণ বাজারের সুদের হারের চেয়ে কম। এতে বৈদেশিক ঋণের ব্যয় কিছুটা বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের গড় অন্তর্নিহিত সুদ হার যেখানে ছিল শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, সেটি ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ ১ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
গত পাঁচ বছরে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৪ হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মার্চ শেষে এ ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৩২৩ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সংখ্যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২১ শতাংশ। বড় ঋণের বেশির ভাগই সরকারের নেওয়া ঋণ, যা শতকরা হিসাবে ৭৩ শতাংশ। আর এ সময়ে বেসরকারি খাত ঋণ নিয়েছে ২৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি উৎস থেকে সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৩৬ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ চার হাজার ৬৭৮ কোটি ডলার ছিল দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৯ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার, যা মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আর বিদেশি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের প্রবৃদ্ধি উচ্চহারে (১৯ শতাংশ) ছিল। ওই সময়ে মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার বা ৮ হাজার ১৫৭ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে (৯ মাসে) আরও ১১ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন বা এক হাজার ১৬৬ কোটি ডলার বেড়েছে।
দেশে এখন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বাড়ছে বিদেশি ঋণ। ২০১৭ সালের শেষে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন বা এক হাজার ২২৮ কোটি ডলার।
বেসরকারি খাতে গত পাঁচ বছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেড়েছে করোনাকালীন সময়ে। এ সময়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে, যার ৭০ ভাগই স্বল্পমেয়াদি।