স্বাধীন বাংলা প্রতিবেদক স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণের মানুষদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা, ঠিক বিপরীত চিত্র লঞ্চমালিক-শ্রমিকদের মধ্যে। তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ব্যাপক।
সেতু উদ্বোধন করার পর থেকে ঢাকা-বরিশাল রুটের বিলাসবহুল লঞ্চগুলো যাত্রীসংকটে পড়েছে। প্রথম এক-দুই দিন যাত্রী কম থাকার বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব দেননি লঞ্চসংশ্লিষ্টরা। ভেবেছিলেন, সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর সেটি দেখার জন্য বুঝি স্রোত সেদিকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলো ফাঁকা যাওয়ার পর রীতিমতো আঁতকে উঠেছেন মালিক-শ্রমিকরা।
যাত্রীদের ফেরাতে ভাড়ায় ছাড় দিয়েও সুফল মিলছে না। গত নভেম্বরে ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর ভাড়া ২২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। তখন লঞ্চমালিকরা দাবি করছিলেন, তাদের পোষাচ্ছে না, সেই তারাই এখন লঞ্চের ভাড়া কমিয়ে দিয়েছেন অনেকটাই।
কিন্তু সড়কপথে অর্ধেক সময়ে যেখানে ঢাকায়-আসা যাওয়া করা যাচ্ছে, সেখানে নৌপথে যাত্রীর চাপ কমবে- এটা আগেই ধারণা করা হচ্ছিল। হয়েছেও তা।
ঢাকা-বরিশাল রুটে লঞ্চ রয়েছে ২৪টি, তবে নিয়মিত দুই ঘাট থেকে চলে ১২টি। বৃহস্পতি ও শুক্রবার এই রুটের লঞ্চের কেবিন থাকত ‘সোনার হরিণের মতো’। সেখানে এখন যাত্রী নিতে হচ্ছে অনুরোধ, অনুনয়-বিনয় করে।
সুন্দরবন-১১ লঞ্চের সুপারভাইজার সিরাজুল ইসলাম জানান, বর্তমানে ডেকের ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২০০, সিংগেল কেবিন ৯০০, সিঙ্গেল এসি কেবিন ১ হাজার, ডাবল কেবিন ১ হাজার ৪০০, ডাবল এসি কেবিন ১ হাজার ৮০০ টাকা।
আগে ডেকের ভাড়া ছিল ৩০০, সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার ১০০, সিঙ্গেল এসি কেবিন ১ হাজার ২০০, ডাবল কেবিন ২ হাজার আর এসি ডাবল কেবিন ছিল ২ হাজার ২০০ টাকা।
তবে ভাড়ায় এই ছাড় দিয়ে লাভ হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেখানে বৃহস্পতিবার যাত্রীচাপ বেশি থাকে, সেদিনও যাত্রী ছিল অর্ধেকের মতো। পদ্মা সেতু চালুর পর আমাদের লঞ্চগুলো ব্যাপক যাত্রীসংকটে পড়েছে।
একই চিত্র দক্ষিণের অন্য রুটেও
পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে বিলাসবহুল ৯টি লঞ্চ আসা-যাওয়া করত উভয় ঘাট থেকে। সেই সংখ্যা এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
সুন্দরবন-১৪ লঞ্চের সুপারভাইজার মো. ইউনুস আশা করছেন, এই দুর্দিন থাকবে না। তিনি বলেন, ‘লঞ্চে যাত্রী কিছু কম, এটা সত্য। তবে তা বেশিদিন থাকবে না। এখন আনন্দ-উল্লাস করতে কিছু যাত্রী পদ্মা সেতু দেখতে সড়কপথে ঢাকা আসা-যাওয়া করছে। আশা করি, ঈদের সিজনেই লঞ্চে যাত্রী আগের মতো স্বাভাবিক হবে।
সুন্দরবন-৯ লঞ্চের সুপারভাইজার মেহেদি হাসান সুমন বলেন, ‘ আগে ডেক ভাড়া ছিল ৫০০ টাকা, এখন নিচ্ছি ৩০০; কেবিন ছিল দেড় ও আড়াই হাজার টাকা, এখন নিচ্ছি ১ হাজার ও ২ হাজার টাকা। আগে কেবিন খালি থাকত না, এখন অনেক কেবিন খালি থাকছে। তবে ডেকের যাত্রী মোটামুটি ভালো আছে।’
দক্ষিণে লঞ্চের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা! আওলাদ-৭ লঞ্চের পটুয়াখালী লঞ্চঘাটের ইনচার্জ আবদুল আজিজ বলেন, ‘লঞ্চের সংখ্যা কম, ভাড়াও কম।’
লঞ্চ চলাচলে সীমিত হয়েছে পিরোজপুরেও। আগে এ জেলা থেকে ঢাকার পথে প্রতিদিন তিন থেকে চারটি লঞ্চ চলত। এখন চলে একটি। মালিকপক্ষ বলছে, যাত্রী কম হওয়ায় ভাড়া দিয়ে জ্বালানির পয়সাও ওঠে না।
এই রুটের লঞ্চ রাজদূত-৮ লঞ্চের পরিচালক সোহাগ হাওলাদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে তিনটা লঞ্চে প্রতিদিন যাত্রী হতো, এখন একটা লঞ্চ ভরতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আসলে পদ্মা সেতু চালু হয়েছে তো তাই যাত্রী সড়কপথে বেশি যাচ্ছে। এ জন্য লঞ্চের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে।’
ঝালকাঠি-ঢাকা রুটে বৃহস্পতি ও শুক্রবার বিকেলে লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে ঘাটে ভিড় নেই।
লঞ্চঘাট ইজারাদার খান এন্টারপ্রাইজের হুমায়ুন কবির সাগর বলেন, ` শুক্রবার যে কয়টি ঘাট টিকিট বিক্রি করেছি, তাতে স্টাফের বেতন উঠবে না। পণ্য আনা-নেয়াও কমে গেছে।’
সুন্দরবন-১২ লঞ্চের ঘাট সুপারভাইজার হানিফ হাওলাদার জানালেন, শুক্রবার ঝালকাঠি থেকে ঢাকার পথে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চে মোট ৯৭টি কেবিন রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি কেবিন বুকিং হয়। এর সাতটি ডাবল এবং ১১টি সিঙ্গেল।
কোরবানি ঈদের আগে আগে এই সময়ে শুক্রবারে কেবিন খালি থাকত না বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘ডেক যাত্রী ছিল ১১৩ জন, যা আগের তুলনায় ৭০ ভাগ কম। ব্যাপক লোকসান আমাদের।’
বৃহস্পতিবার ঢাকার উদ্দেশে ঝালকাঠি ছাড়ে ফারহান-৭। ওই লঞ্চেও একই অবস্থা।
যারা নৌপথ ব্যবহার করছেন তারা বলছেন, বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে লঞ্চে যাতায়াত সুবিধা। তাই লঞ্চে যাচ্ছেন। বাকিরা যাচ্ছেন সড়কপথে।
বরগুনা থেকে ঢাকা রুটে আগে একেকটি লঞ্চ ৪০০-৫০০ যাত্রী পেত। এখন ১০০ যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা-বরগুনা, ঢাকা-আমতলী নদীপথে আটটি বিলাসবহুল লঞ্চ চলছে। এর মধ্যে ঢাকা-বরগুনা পথে পাঁচটি ও ঢাকা-আমতলী রুটে তিনটি।
দক্ষিণে লঞ্চের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা! আমতলী লঞ্চঘাটের টোল আদায়কারী হানিফ গাজী বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে প্রতিদিন বেলা ২টার মধ্যে দেড় থেকে দুই শতাধিক যাত্রী ঘাটে টোল দিয়ে লঞ্চে উঠে বিছানা পেতে বসে থাকতেন। কিন্তু এখন ৭০-৮০ জন যাত্রী হয়। বৃহস্পতিবার এ ঘাট থেকে ৮০ জন যাত্রী নিয়ে এমভি তরঙ্গ ঘাট ছাড়ে। শুক্রবার ইয়াদ লঞ্চও সমপরিমাণ যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায়।’
মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় বরগুনা নদীবন্দর থেকে এমভি পূবালী ও রাজহংস-৮ নামের দুটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। শুক্রবার অবশ্য রাজারহাট-বি নামের একটি লঞ্চ ছেড়েছে।
এমকে শিপিং লাইনসের বরগুনা ঘাটের ব্যবস্থাপক এনায়েত মিয়া বলেন, ‘যাত্রী কম হওয়ায় আজ একটি লঞ্চ ছাড়া হয়েছে। লঞ্চটিতে ৮০-৯০ জন যাত্রী ছিল। এ লঞ্চে সিঙ্গেল ও ডাবল কেবিনের সংখ্যা ১২৬। এর মধ্যে মাত্র ৪০টি কেবিন বুকিং হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের লঞ্চ চলাচলেই লস হয়।’
এই রুটের লঞ্চ শাহরুখ-২-এর মাস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘সেতু চালু হওয়ার পর থেকে লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা কমে গেছে। এর প্রভাব বেশ কিছুদিন থাকবে। মাসখানেক পর যাত্রীসংখ্যা বাড়বে। কারণ সবাই পদ্মা সেতু দেখার জন্য এখন গাড়িতে করে ঢাকায় যাচ্ছে।’
এমভি তরঙ্গ-৭ লঞ্চের সুপারভাইজার হুমায়ুন কবির বলেন, ‘চার দিন লঞ্চ বন্ধ ছিল যাত্রী কম থাকায়। পদ্মা সেতুর প্রভাব নদীপথে পড়বে কি না তা এখনই বলা যাবে না। কিছুদিন গেলে বোঝা যাবে।’
কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘আমাদের টিকে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আশা করছি অবস্থা এমন থাকবে না। কয়েক মাস পর ঠিক হয়ে যাবে।’
|