সুমাইয়া আক্তার আত্মহত্যা মহাপাপ। আইনের দৃষ্টিতেও অপরাধ। পৃথিবীর সকল ধর্ম এবং নৈতিকতা আত্মহত্যার বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছে। গত ২০২১ সালে ১০১জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সমাজসেবী সংগঠন আচরণ ও গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা যায় আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশেরও বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ তো গেল গত বছরের ঘটনা ২০২২ সালের অর্ধেক পেরোতে না পেরোতেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।
গত একমাসে বহুল আলোচিত আত্মহত্যার মধ্যে যেগুলো খুবই উল্লেখযোগ্য ঘটনা সেগুলো হলো- অতি সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের (৪৫তম আবর্তন) শহীদ রফিক জব্বার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী অমিত কুমার বিশ্বাস ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মারা যাওয়ার পর তার রুম থেকে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া যায়। এর কিছুদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের মেধাবী শিক্ষার্থী অঙ্কন বিশ্বাস বিষপান করে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে মারা যান। যদিও এখনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি যে এটি আত্মহত্যা ছিল নাকি পরিকল্পিত খুন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের সাদিয়া তাবাসসুম নামে এক শিক্ষার্থী নিজ ঘরে বাঁশের আড়ার সঙ্গে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
আত্মহত্যা প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দিন যাচ্ছে আর প্রতিদিনের খবরের কাগজে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার সংবাদ রচিত হচ্ছে। গত ২৩শে মে একই দিনে তিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এরা হলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০- ২১ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র আবিদ বিন আজাদ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস এর একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ওয়াফিয়া এবং সাভারের আশুলিয়ার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ৭ম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী তানভীর অয়ন।
আত্মহত্যা প্রবণতা কত বেড়ে গেছে চিন্তা করা যায় কি যে একই দিনে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যা কি আদৌ কোন কিছুর সমাধান হতে পারে! আমরা আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে খুঁজে পাই বিভিন্ন কারণ। তবে বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে বলেছেন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করার পেছনে যে কারণগুলো উল্লেখযোগ্য তা হল- দরিদ্রতা, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, চাপ, হতাশা, নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হীনতা, আত্মবিশ্বাস এর ঘাটতি ইত্যাদি। এসব কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ বেছে নেয়। কিন্তু এই আত্মহত্যা তো কোনো কিছুর সমাধান না। পৃথিবীর কোনো ধর্মই আত্মহত্যা কে সমর্থন করে না। তবুও মানুষ এ নিকৃষ্ট পথ বেছে নেয়।
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এটি প্রমাণিত যে আত্মহত্যা মারাত্মক অপরাধ ও হারাম কাজ। আর এর পরিণত খুবই ভয়াবহ। আত্মহত্যাকারীকে জাহান্নামের আগুনে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আত্মহত্যা সম্পর্কে আল্লাহ ঘোষণা করেন - "তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল।" ( সূরা আন নিসা আয়াত: ২৯) অপর একটি আয়াতে বলা হয়- "তোমরা নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।" (সূরা বাকারা আয়াত: ১৯৬)
আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে হলে নীতিনির্ধারকদের প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে আরো বেশি করে সমন্বিত প্রকল্প কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মের সুযোগ সৃষ্টি ও কর্ম নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ক্যারিয়ার চিন্তা থেকে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা গুলো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে এখনই পদক্ষেপ নিতে না পারলে পরে আমাদের অনুশোচনা করতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় দায়িত্বশীলদের অবদান রাখার সময় এখনই।
দিনের-পর-দিন বেড়ে চলা এই আত্মবিনাশের পরিত্রাণের ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ না করলে খুব শীগ্রই এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আত্মহত্যা করলে শুধু একজন ব্যক্তিই মারা যায় না, তার সাথে তার পুরো পরিবার জড়িত। তারা ভেঙে পড়ে, হারায় প্রিয়জন। সাময়িক দুঃখ, কষ্ট, চিন্তা বা হতাশার জন্য যে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে তার জন্য সে দুনিয়া আখিরাত দুটোই হারাচ্ছে। দুর্দিন সব সময় থাকে না। সময় ঘুরে সুদিন ফিরে আসে। নেপোলিয়ন বেনাপার্ট তার বিখ্যাত উক্তিতে বলেছেন , "আত্মহত্যা জীবনের সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়।" জীবনের সার্থকতা আত্মহত্যা নয়, জীবন একটাই এখানে অনেক বাধা বিপত্তি আসবে অনেক প্রতিকূলতা পেরোতে হবে।
দুঃখের পর সুখ আসবে। অন্ধকার রাতের পর রৌদ্রজ্জ্বল সূর্য দেখা দেবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির নিয়মেই আমাদের জীবনে দুঃখ কষ্ট আসে। সেই দুঃখ কষ্টে আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। দৃঢ় বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। দুঃখ নামক নদী সাঁতরে পার করতে পারলেই সুখ নামক স্বর্গভূমির দেখা মিলবে।তাই আত্মহত্যা নয় জীবনে দুঃখ-কষ্ট যাই আসুক মেনে নিতে হবে। জীবনটাকে উপভোগ করতে হবে। জীবন একটাই, একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই একমাত্র জীবনের দুঃসময় সুসময় দুটোই হাসিমুখে পার করতে হবে।
সৃষ্টিকর্তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে। যে প্রাণটা আপনি শেষ করতে চাইছেন এটা স্রষ্টার সৃষ্টি পৃথিবীর কোন মানুষ তা সৃষ্টি করতে পারবে না। আর সেই স্রষ্টার সৃষ্টি কে ধ্বংস করার পরিণাম যদি কেউ স্বচক্ষে দেখতে পারতো তাহলে আর কেউ আত্মহত্যা করত না। সাময়িক দুঃখ কষ্টের জন্য আত্মহত্যা করতে গিয়ে মানুষ নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে অনন্তকালের জাহান্নামের আগুনে। তাই আসুন আত্মহত্যাকে না বলি জীবনকে উপভোগ করতে শিখি। সুখ দুঃখ সব মেনে নিয়ে জীবনটাকে সুন্দর ও উপভোগ্য করে তুলি।