সাকিবুল ইসলাম প্রতিটা প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এটা আমরা সবাই জানি, এটাও জানি মৃত্যু নিশ্চিত, এটা থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই মৃত্যুর সাথে আরো একটি শব্দ যেটা প্রায়ই আমরা দেখি তা হলো আত্মহত্যা। বর্তমান সময়ে এটির প্রবণতা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কিন্তু কেন এই আত্মহত্যা? এটাই কি সকল সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়? কিসের আশায় মানুষ নিজের জীবনকে নিজেই হত্যা করছে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই সামনে চলে আসে আত্মহত্যার করুণ রূপ!
কখনও কি ভেবে দেখেছেন আপনার আশপাশে থাকা একজন বিকলাঙ্গ মানুষ বা গরিব দিনমজুর জীবনের প্রতিকূলতার মাঝে থেকেও খুশি মনে কীভাবে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে? অথচ আপনি সামান্য কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য আত্মহত্যার কথা ভাবছেন! আত্মহত্যা মানেই সবকিছুর সমাধান নয় বরং জীবনযুদ্ধে হার মেনে নেওয়া। ভাঙা-গড়ার চিরায়ত নিয়ম মেনেই জীবন সুন্দর। বেদনা, একাকিত্ব, দুঃখ জীবনেরই অংশ। সুখের পর দুঃখ আবার দুঃখের পর সুখ— এ চক্রেই আমাদের জীবন আবদ্ধ। এ কথাগুলো কমবেশি আমরা সবাই জানি। তবু কেউ কেউ বেদনার সঙ্গে লড়তে ভুলে যাই, নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখার আগেই আত্মহনন করে বসি। আমাদের মাথায় থাকে না এ চলে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া।
প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারি বলেই আমরা মানুষ। আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। ভাঙা-গড়ার প্রাকৃতিক নিয়মকে অস্বীকার করে মানবজন্মকে বৃথা করা আমাদের উচিত নয়। কিছু সময় জীবনে আসবেই যেগুলো পার করা সত্যিই কষ্টকর। কেউ পাশে না থাকা বা গভীর একাকিত্ব, কিংবা বিচ্ছেদ অথবা ব্যর্থতার বৃত্তে আবর্তিত হওয়া— এগুলো সবার জীবনেই আসে এবং আসবেই। এটাই সত্য। নিজের জীবনকে খুব বেশি ভালোবাসতে হবে৷ জীবনের গূঢ় সত্যটা ভাবলে দেখা যায়, বেদনাও সুন্দর। বেদনাকেও উপভোগ করা যায়। প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজেকে সময় দেয়া, নিজের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করা। তারপর পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র। প্রতিটি মানুষের উচিত ভালো ও ইতিবাচক চিন্তার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং তাদের সঙ্গে সময় কাটানো। নিজেকে মানসিকভাবে সতেজ রাখাও সুখী জীবনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অবসর সময়টাকে একাকিত্ব হিসেবে না দেখে নিজের প্রিয় কোনো কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে। সেটা হতে পারে আড্ডা, বইপড়া, টিভি দেখা, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা। যারা একাকিত্ব অনুভব করেন তারা সম্পর্ক গড়ায় মনোযোগ দিন। ইতিবাচক মানুষের সংস্পর্শে আসুন, শখের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন, ধর্মকর্ম পালনে মনোযোগ দিন। দেখবেন জীবন অনেক উপভোগ্য। যারা ব্যর্থতার চক্রাকারে আবদ্ধ তারা লড়াই করুন। পরিশ্রম কখনো কাউকে নিরাশ করে না। নিজেকে ব্যর্থ মনে করে পৃথিবীকে যত কুৎসিত মনে করছেন, একবার শুধু সফল হোন, ততগুণ বেশি সুন্দর দেখবেন পৃথিবীকে।কিছু মানুষ রয়েছেন যারা আত্মহনন করেন হীনম্মন্যতায়, মর্যাদাহানিতে, অপরাধের শিকার হয়ে। তাদের উদ্দেশে বলব ফিরে আসতে হবে। একটু চেষ্টা করলেই নতুন জীবনে ফেরা সম্ভব। আমাদের সবার জীবনের মূলমন্ত্র একই, তা হলো লড়াই বা যুদ্ধ।
একজন ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্য বহাল রাখার দায়িত্ব সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারেরই। কেউ ব্যর্থ হলে, অন্যায় করলে কিংবা কারো সঙ্গে অন্যায় হলে তাকে মানসিক সমর্থন দিতে হবে। তাকে ধিক্কার দেয়া, মানসিকভাবে অপদস্ত করা বা সামাজিকভাবে হেয় করা কোনো অবস্থাতেই উচিত নয়। কাউকে মানসিকভাবে সতেজ রাখার উপায় হলো তাকে সঙ্গ দেয়া। বর্তমানের অধিকাংশ আত্মহত্যাই হলো নিঃসঙ্গতাজনিত। নিজের বন্ধু, পরিবারের কেউ বা সমাজের কেউ নিঃসঙ্গতায় ভুগলে তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। তাকে মানসিক সমর্থন দিতে হবে। আত্মহত্যা সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। না হয় জাতির জন্য সামনে অপেক্ষা করছে অশনি সংকেত! আমাদের বিষণ্ন লাগতেই পারে। এই বিষণ্ন লাগা, হতাশ লাগা এগুলো কোনো বড় ঘটনা নয়। শরীরের রোগের মতো মনের রোগের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতন প্রয়াস আরও বাড়াতে হবে। আমাদের মনের যত্ন নিতে হবে। সব থেকে বেশি যা দরকার তা হলো, আমাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গাকে মজবুত করতে হবে। জীবনে আঘাত, দুঃখ, বেদনা, কষ্ট আসে জীবনকে শক্ত করার জন্য; মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য নয়। মনে রাখতে হবে, মৃত্যু আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়, বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। আমরা চাই, মানুষ নিজেকে ভালবেসে বেঁচে থাকুক, আত্মহত্যার এই দুঃখগাঁথার ইতি ঘটুক।
লেখক : সাকিবুল ইসলাম শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা সদস্য, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি ফিচার, কলাম অ্যান্ড কনটেন্ট রাইটার্স