মুফিজুর রহমান নাহিদ: পানিতে ভাসছে প্রকৃতিকন্যা সিলেট। আজ সকাল থেকে আরও প্রবল বেগে হু হু করে বাড়ছে পানি। সুরমা-কুশিয়ারাসহ নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির স্রোতে খরস্রোতা সুরমা ও সিলেট নগর একাকার। নদী আর রাস্তার কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জেলার ১৩টি উপজেলায়ই বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সুনামগঞ্জেও বন্যা অবনতির অভিন্ন চিত্র।
নতুন করে প্লাবিত হয়েছে সিলেট-সুনামগঞ্জের শত শত গ্রাম ও এলাকা। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট, মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিপর্যস্ত বিদ্যুত ব্যবস্থাও। এ অবস্থায় মানুষের মাঝে রীতিমতো হাহাকার বিরাজ করছে। সে অনুযায়ী এলাাকাগুলোতে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা একেবারেই অপ্রতুল। এ অবস্থায় গতকাল জরুরি বৈঠক করেছে সিলেট জেলা প্রশাসন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, মঙ্গলবার সুরমা নদীর পানি কানাইঘাটে বিপদসীমার ১৪৩ সেন্টিমিটার ও কুশিয়ার নদীর পানি ১৫০ সেন্টিমিটার, সুরমার পানি সিলেটে ২৯ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জে ৩৫ মিলিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এছাড়া কুশিয়ারার পানি অমলশীদে বিপদসীমার ১৩৮ সেন্টিমিটার ও শেওলা স্টেশনে ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্যায় সবচেয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও সিলেট সদর উপজেলা। জেলার ১৩টি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে বলে স্থানীয় মানুষজন ও জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। কানাইঘাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু স্থান এবং বিভিন্ন হাটবাজারে আশ্রয় নিয়েছেন। গবাদি পশু নিয়ে চরম বেকায় পড়েছেন এসব মানুষ। একই সাথে খাদ্য সংকটে ভুগছেন বন্যায় বাড়িছাড়া মানুষ। অনকে হাটবাজা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে কানাইঘাটে বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টি ছাড়াই হু হু করে বাড়ছে পানি। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বন্যাকলিত এলাকার মানুষ। নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবার পর দুর্গতরা যেসব উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবার সেই উঁচু স্থানও তলিয়ে যেতে শুরু করেছে।
স্থানীয় লোকজন বলেন, এক সপ্তাহ ধরে ভারতের উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামছে। পাশাপাশি সিলেটে ভারী বৃষ্টিও হচ্ছে। এতে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলায় বন্যা হয়েছে। জেলার প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ অন্য নদ-নদীর পানি উপচে একের পর এক এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জেলা ও উপজেলার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী অন্তত ১০টি সড়ক তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে ফসলের খেত, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। অসংখ্য বাসাবাড়িতেও পানিতে ঢুকেছে।
এদিকে, একই চিত্র সিলেট মহানগরীর। এখন পর্যন্ত নগরীর অর্ধেক রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। এসব এলাকায় সড়কের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও আবার কোমরসমান। জমে থাকা পানিতে ভাসছে বারোয়ারি ময়লা-আবর্জনা আর পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল ও ককশিট। কোথাও কোথাও ভাসছে মানুষের মলও। পানি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দুর্গন্ধযুক্ত পানি মাড়িয়েই স্থানীয় বাসিন্দারা চলাচল করছেন। ক্রমবর্ধমান হারে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমশই অবনতির দিকে যাচ্ছে।
নগরের রোজভিউ হোটেলের সামনে দিয়ে উপশহর এলাকামুখী রাস্তায় থই থই করছে ঘোলা পানি। হোটেল থেকে ১০০ গজ দূরে পানির তোড়ে একটি দীর্ঘদেহী গাছ হেলে পড়ে আছে। সড়কের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও আবার কোমর সমান। জমে থাকা পানিতে ভাসছে বারোয়ারি ময়লা-আবর্জনা। কোথাও কোথাও ভাসছে মানুষের মলও। পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
দুই দিন ধরে এ অবস্থা চলছে সিলেট নগরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত শাহজালাল উপশহরে। নগরের মাছিমপুর, সোবাহানীঘাট, কালীঘাট, ছড়ারপাড়, তালতলা, তেরোরতন, মেন্দিবাগ, তোপখানা, কলাপাড়া, জামতলা, মণিপুরি রাজবাড়িসহ অন্তত ২৫টি এলাকায় কমবেশি একই দৃশ্য দেখা গেছে। দুর্গন্ধযুক্ত পানি মাড়িয়েই স্থানীয় বাসিন্দারা এখন চলাচল করছেন।
এতে লাখো মানুষ পানিবন্দী জীবন যাপন করছে। রাস্তাঘাটের পাশাপাশি বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। অনেক জায়গায় চুলা নলকূপও ডুবেছে। পানি মাড়িয়ে রাস্তা দিয়ে বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, রিকশাসহ অন্যান্য যান চলাচল করছে। তবে রাস্তা ও নালা-নর্দমা একাকার হয়ে যাওয়ায় অনেক যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। ফলে তুলনামূলক কম যানবাহন এসব এলাকায় চলাচল করছে। এতে অফিসসহ জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া লোকজন পড়েছেন আরও ভোগান্তিতে। যানবাহন সংকটে তাঁরা নোংরা পানি মাড়িয়ে হেঁটে ভিজেই গন্তব্যে যাচ্ছেন। বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে যাওয়ায় অনেকে ইটের মধ্যে কাঠ ফেলে ঘরের মধ্যে চলাচল করছে। অনেকের রান্নাঘর তলিয়ে যাওয়ায় বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে। শুধু খাবার ও পানি সংকটই নয়। সিলেট নগরের বন্যাক্রান্ত এলাকাগুলোতে বিদ্যুত ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত। দক্ষিণ সুরমায় সাবস্টেশন ও কন্ট্রোল রুম তলিয়ে যাওয়ায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উপজেলা সদর ও প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে বিদ্যুতের চিত্র আরো ভয়াবহ। এ অবস্থায় অন্তহীন দুর্ভোগ-ভোগান্তির মাঝে দু:সহ সময় পার করছেন মানুষ। এদিকে, সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, নগরীর ৭টি ওয়ার্ডে ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কেন্দ্রে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, সুরমা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নগরের খাল-ছড়াগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে না। নদীর পানি উপচে তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাত না কমলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তবে আমরা পুরো বিষয়টি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখছি।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ভারত থেকে নেমে আসা ঢলেই মূলত এ বন্যা দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার সকালেও কয়েক দফা ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে যেখানে হাঁটু পানি ছিল, সেখানে দেখা দিয়েছে কোমর সমান পানি। বাড়িতে পানি ঢুকায় গবাদিপশু কোথায় রাখবেন, এ নিয়েও অনেক গৃহস্থ বিপাকে পড়েছেন। প্লাবিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। দ্রুত প্লাবিত এলাকায় সরকারি ত্রাণ পৌঁছানোর দাবিও জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ১ হাজার ৫৩৪ হেক্টর বোরো জমি, ১ হাজার ১২৭ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা এবং ২৪৩ হেক্টর সবজির জমি তলিয়ে গেছে। যদিও প্রকৃত পরিমাণ এর চেয়ে আরো বেশী বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন বৈঠক করেছে। পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে প্লাবিত এলাকার মানুষজের জন্য ত্রাণসামগ্রীও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমানের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় প্রশাসন সার্বক্ষণিক প্লাবিত এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মুজিবর রহমান বলেন, ‘বন্যার্তদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি।’
আরো অবনতির পূর্বাভাস : সিলেট অঞ্চলের নদীর পানি আরও বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। গত মঙ্গলবার দুপুরে নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস প্রতিবেদেনে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে। সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবী : সিলেটের কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ এ চার উপজেলাকে বন্যাদুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে জৈন্তিয়া কেন্দ্রীয় পরিষদ নামের স্থানীয় একটি সংগঠন। স্মারকলিপিতে ওই চার উপজেলাকে বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণা করে দ্রুত পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তা প্রদানের পাশাপাশি তলিয়ে যাওয়া রাস্তাঘাট মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।