সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ি নৌবন্দর প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছরেও উন্নয়নের ছোয়া লাগেনি। অপরদিকে ৩৯ বছরে সরকারের বিআইডব্লিউটিএ রাজস্ব হারিয়েছে এক হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। বন্দরটি দিন দিন নানা সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়েছে। এখানে নেই কার্গো জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের পর্যাপ্ত জেটি, গুদাম ও সেট। এছাড়া এখানে নেই ট্রাকস্ট্যান্ড, উন্নত রাস্তাঘাট, জাহাজ শ্রমিক ও লেবারদের পৃথক পৃথক বিশ্রামাগার এবং খাবার ক্যান্টিন। ফলে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে তা বছরের পর বছর খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখতে হয়। এতে রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। পর্যাপ্ত যেটি না থাকায় পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়। ফলে সঠিক সময়ে গন্তব্যে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। ট্রাকস্ট্যান্ড না থাকায় যত্রতত্র দাড়িয়ে থাকায় বন্দরে প্রায়ই ট্রাক জটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া হাতের কাছে ট্রাক না পাওয়ায় পণ্য পরিবহণ বিলম্ব হয়। জাহাজ শ্রমিক ও পণ্য খালাসের লেবারদের বিশ্রমাগার ও খাবার ক্যান্টিন না থাকায় তারা সঠিক ভাবে বিশ্রাম নিতে পারে না ও অমানবিকভাবে তাদের খোলা স্থানের মাটিতে অথবা কোন ঘরের বারান্দায় বসে খাবার খেতে হয়। রাস্তাঘাট উন্নত না হওয়ায় পণ্যবাহী ট্রাক ও অন্যান্য যানবহণকে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।
এ বিষয়ে বাঘাবাড়ি নৌবন্দরের লেবার এজেন্ট আবুল হোসেন বলেন, ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ি নৌবন্দর প্রতিষ্ঠা হয়। তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী ডা. এম এ মতিন এ বন্দরের উদ্বোধন করেন। এরপর ৩৯ বছর পার হলেও বন্দরটিকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়নি। দ্বিতীয় শ্রেণির এ বন্দর চ্যানেলটিতে পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচলে সাড়ে ৭ ফুট পানির ড্রাফট প্রয়োজন হয়। কিন্তু নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে ৬-৭ ফুটের বেশি পানির ড্রাফট থাকে না। ফলে সে সময়ে ৬-৭ হাজার মেট্রিক টনের বেশি পণ্যবাহী জাহাজ এ বন্দরে আসতে পারে না। বন্দরটি প্রথম শ্রেণিতে উন্নিত হলে এ বন্দর চ্যানেলে ১২ থেকে ১৪ ফুট পানির ড্রাফট থাকবে। তখন খুব সহজে এ চ্যানেলে ১২ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কার্গো জাহাজ অনায়ায়েশে যাতায়াত করতে পারবে। এতে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলায় জ্বালানী তেল, রাসায়নিক সার, কয়লা, পাথর, রড, সিমেন্ট, ধান, চাল ও অন্যান্য মালামাল পরিবহন খরচ অর্ধেক কমে যাবে। এছাড়া এ বন্দরটি প্রথম শ্রেণির হলে, এর রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হবে। তখন যানবহণের ক্ষতি হবে না। এখানে পণ্য রাখার জন্য পর্যাপ্ত গুদাম ও সেড থাকবে। ফলে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে গুদাম ও সেডে রাখা হবে। এতে রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে পণ্যের গুণমান নষ্ট হবে না। অপরদিকে গুদাম ও সেড ভাড়া দিয়ে বিআইডব্লিউটিএ ৩ গুণ বেশি রাজস্ব আয় করবে। তিনি আরও বলেন, এ বন্দরে অন্তত ৬টি জেটির প্রয়োজন। সেখানে আছে ৩টি। এতে পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়। কোনো কোনো জাহাজকে পণ্য খালাসের জন্য ১৫-২০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। আবার লেবার খরচও বেশি পড়ে। এটা প্রথম শ্রেণির হলে জেটি সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ও যান্ত্রিক জেটি দ্বারা পণ্য খালাস হবে। এতে লেবার খরচ কম হবে ও সময় বেচে যাবে। তিনি বলেন এ বন্দরটি থেকে বিআইডব্লিউটিএ এখন প্রায় ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। এটি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হলে এর ৩ গুণ রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সে হিসাবে বিআইডব্লিউটিএ ৩৯ বছরে এ বন্দর থেকে রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। এছাড়া জাহাজ শ্রমিক ও পণ্য খালাসে নিয়োজিত লেবারদের বিশ্রামাগার ও ক্যান্টিন না থাকায় জাহাজ শ্রমিকরা এ বন্দরে আসতে চায় না। ফলে এ বন্দরে আশানুরূপ জাহাজ আসে না। এতে বন্দর লেবার এজেন্ট হিসাবে আমাদের প্রতি বছর ২ থেকে ৩ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। অপরদিকে লেবারদের ক্যান্টিনের অভাবে খোলা স্থানে বসে খাবার খেতে হয় ও গাছ তলায় বিশ্রাম নিতে হয়। প্রথম শ্রেণির হলে এ সমস্যার সমাধান হবে।
তিনি আরও বলেন, এ বন্দরের স্থান সংকুলান না হওয়ায় বন্দরের পূর্ব পাশের প্রায় ৩৪ শতক ব্যক্তি মালিকানা জায়গা ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করতে হয়। এতে আমাদের বছরে ৪ লাখ টাকা দিতে হয়। এটি প্রথম শ্রেণির হলে এবং ওই জায়গাটি বিআইডব্লিউটিএ অধিগ্রহণ করে নিলে আমাদের এ অতিরিক্ত অর্থদন্ড লাগবে না। তিনি বলেন, বন্দরটি প্রথম শ্রেণির করতে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে তদবির করছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসিনতার কারণে এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সাবেক নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান বাঘাবাড়িতে ২ বার এসে এটি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করে দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তারপরেও কোন কাজ হয়নি। তিনি বলেন, সর্বশেস গত ১৫দিন আগে এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য প্রফেসর মেরিনা জাহান কবিতাসহ নৌ প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ ও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডোর গোলাম সাদেকের সাথে দেখা করে বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু এখনও কোন কাজ হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নৌযান ফেডারেশন, বাঘাবাড়ি নৌবন্দর শাখার পরিচালক আব্দুল ওয়াহাব মিয়া বলেন, এ বন্দরটি প্রথম শ্রেণির না হওয়ায় এখানে বড় বড় জাহাজ আসতে পারে না। অপরদিকে এখানে জাহাজ শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত কোন সুবিধা না থাকায় শ্রমিকরা এ বন্দরে আসতে চায় না। যারা আসে তাদের বিশ্রমাগারের অভাবে চরম অসুবিধা পোহাতে হয়। তিনি এ বন্দরটি দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে উন্নিত করে এ সমস্য সমাধানে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে বাঘাবাড়ি নৌবন্দর লেবার সাগর আলী, সোবাহান আলী, মজনু মিয়া, নজরুল ইসলাম ও সেলিম হোসেন জানান, বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে লেবারদের জন্য বিশ্রমাগার ও ক্যন্টিন না থাকায় আমাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। কাজ শেষে আমরা কখনো বিশ্রাম নিতে পারি না গাছ তলা বসে সময় কাটাতে হয়। ক্যান্টিনের অভাবে খোলাস্থানে বসে খাবার খেতে হয়। এ সমস্যা দূর করতে দ্রুত এ বন্দরটিকে তারা প্রথম শ্রেণিতে উন্নিত করণের দাবী জানান।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক ও বাঘাবাড়ি নৌবন্দর কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান জানান, এ বন্দরটির উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি একনেকে পাশ হলে অচিরেই এর কাজ শুরু হবে। তখন আর এ সমস্য গুলি থাকবে না। তিনি বন্দরটি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করণের ব্যাপারে বলেন, এটা প্রথম শ্রেণিতে উন্নিত হোক তা আমরাও চাই। এটি হলে এখানে পণ্য খালাস ও সংরক্ষণের সুব্যবস্থা হবে। বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে ও উত্তরবঙ্গর ১৬ জেলায় পণ্য সরবরাহ আরও সহজ হবে।