প্রকল্পের নাম অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি। স্থানীয়দের কাছে ৪০ দিনের কর্মসূচি হিসেবে বেশি পরিচিত। সাধারণত এ প্রকল্পের মাধ্যমে রাস্তা মেরামত, নতুন রাস্তা নির্মাণসহ গ্রামীণ উন্নয়নের কাজ করা হয়। স্বচ্ছতা বজায় রাখতে জাতীয় পরিচয়পত্র দ্বারা নিবন্ধনকৃত মোবাইল সীম এবং বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে শ্রমিকদের নামের তালিকা করা হয়। প্রকল্পের স্বচ্ছ তালিকা প্রনয়ণে আর কর্মকর্তাদের কাজের তদারকির প্রতিবেদনে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সাগরদিঘি ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের জন্য প্রকল্পে নাম রয়েছে কলেজ শিক্ষক, স্কুল শিক্ষক, পল্লী চিকিৎসক, চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতাসহ আরও অনেকের। তবে শ্রমিক নামধারী এসব লোকের দাবি এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে চারটি প্রকল্পে ৮২ জন শ্রমিকের বিপরীতে সাগরদিঘি ইউনিয়ন বরাদ্দ পায় ১৩ লাখ ১২ হাজার টাকা। কাজ ছিল রাস্তা মেরামত। প্রকল্পের কাজ চলতি বছর জানুয়ারিতে শুরু হয়ে শেষ হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। দুইধাপে দেওয়া হয় মজুরির টাকা। ওই ইউনিয়নের শ্রমিকরা প্রথম ধাপে টাকা না পেলেও দ্বিতীয় ধাপের টাকা পেয়েছেন। প্রকল্পে শ্রমিকের তালিকায় নাম রয়েছে ঘাটাইলের ফুলমালিরচালা কারিগরী বি.এম.এ কৃষি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক মো. হাসান আলীর (৩৪)। তিনি জানান, একদিন করিমগঞ্জ গ্রামের মেহের আলী নামে একজন এসে জানালেন কোনো এক কাজে চেয়ারম্যান তার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি এবং ছবি চেয়েছেন। সরল বিশ্বাসে তিনি দিয়ে দেন। এরপর তিনি তার ব্যবহৃত মোবাইল সীমকার্ডে ৭ হাজার ২৫০ টাকার একটি বার্তা দেখতে পান। পরে ওই মেহের নামের লোক এসে টাকা তুলে নিয়ে যান। খোঁজ নিয়ে জানা যায় মেহের সাগরদিঘি ইউনিয়ন যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য। দীর্ঘদিন তিনি সিঙ্গাপুর ছিলেন। তারও নাম রয়েছে তালিকায়।
মামুন হোসাইন প্যারা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন করিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যোগ দিয়েছেন রফিক-রাজু স্কুলে। তালিকায় তারও নাম রয়েছে। তবে তালিকায় যে ফোন নম্বরটি দেওয়া আছে সেটি তার নয়। তবে বাড়ি থেকে কেউ একজন এসে কাগজপত্র নিয়ে গেছে বলে তিনি জানান। তালিকায় আরও যাদের নাম রয়েছে; মজনু মিয়া ডিলারশীপের ব্যবসা করেন। সাগরদিঘি বাজারে মীম ইলেক্ট্রনিক্স, জোরদিঘি বাজারে মায়ের দোয়া ইলেক্ট্রনিক্স এছাড়াও সখীপুরের বড়চওনা বাজারেও রয়েছে তার ইলেক্ট্রনিক্সের শো’রুম।
কামাল হোসেন একজন পল্লী চিকিৎসক। জোরদিঘি বাজারে আছে তার কামাল ফার্মেসি নামে দোকান। নাজমুল হক চাকুরি করেন সখীপুরে। মাসুদ রানা সাগরদিঘি ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর। বাদ যায়নি প্রভাবশালীদের নামও। সাগরদিঘি এলাকার যে ক’জন বড় ব্যবসায়ী আছেন সোহরাব আলী তাদের মধ্যে একজন। ইদ্রিস আলী লিটন প্রায় দশবিঘা সম্পত্তির মালিক। রয়েছে লেবু ও কলার ব্যবসা। বাড়িতে দালানসহ কাদের সিকদারের সাগরদিঘি বাজারে রয়েছে সিকদার মার্কেট।
কাজ না করে অর্থ আত্মসাতের জন্য চেয়ারম্যান কতৃর্ক এমন অসংগতিপূর্ণ শ্রমিকের নামের তালিকা দেখে বিব্রত ওই ইউনিয়নের সদস্যরা। ২নং ওয়ার্ড সদস্য শফিকুল ইসলাম জানান, তার জানামতে সাগরদিঘি ইউনিয়নে শ্রমিক দ্বারা কোনো কাজ হয়নি। সিকদারপাড়া মোড় থেকে বিমানপাড়া মোড় পর্যন্ত প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনো শ্রমিক ওই রাস্তায় কাজ করেননি। তিনি আরও জানান, তার এলাকা থেকে নয়জন লোকের মোবাইল সীমকার্ড সংগ্রহ করে দিতে বলেন চেয়ারম্যান। পরে ছয়টা সীম চেয়ারম্যান রেখে তিনটা সীম তাকে দেন। সেই তিনটা সীমে সাত হাজার করে মোট ২১ হাজার টাকা জমা হয়। সেখান থেকে নাকি চেয়ারম্যান ১০ হাজার টাকা চাচ্ছেন।
৭নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য ফরহাদ আলী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্পে দশ টাকার কাজ হয়েছে এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। ৫নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য সুরুজ মিয়া জানান, তাকে নয়জন শ্রমিক দেওয়া হয়েছিল কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শ্রমিকনামধারী লোকদের মোবাইল থেকে টাকা উত্তোলন করে জমা করা হয় ইউপি সচিবের কাছে। পরে তা ভাগবাটোয়ারা করা হয়। একই সুর দু’একজন বাদে বাকী ইউপি সদস্যেদের।
সাগরদিঘি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হেকমত সিকদার বলেন, টাঙ্গাইল জেলা এবং সারাদেশে যেভাবে কাজ হয় আমার এখানেও সেভাবে হয়েছে। শ্রমিকও কাজ করেছে, ভ্যাকু (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়েও কাজ করা হয়েছে। তবে শ্রমিকের নামের তালিকায় স্কুল-কলেজ শিক্ষক, চাকুরিজীবী ও প্রভাবশালীদের নাম থাকার বিষয়সহ অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
ওই ইউনিয়নে শ্রমিক ও কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা (ট্যাগ অফিসার) উপজেলা সহকারি মৎস কর্মকর্তা আনিছুর রহমানের দাবী, শ্রমিক উপস্থিতি ছিল শতভাগ এবং কাজ হয়েছে ভালো। তিনি আরও বলেন, বিল উত্তোলনের জন্য প্রকল্পে শ্রমিকদের তালিকায় তারসহ যেসকল কর্মকর্তাদের সই লাগে সবাই তা করে দিয়েছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, আংশিক বিল দেওয়া হলেও শতভাগ শ্রমিকের বিল পরিশোধ করা হয়নি। এ ধরনের অনিয়মের প্রামাণ পেলে শ্রমিকের নামের তালিকা সংশোধন করে পরবর্তী বিল প্রদান করা হবে। আর যদি শ্রমিক ব্যতিত অন্য কোনো উপায়ে প্রকল্পের কাজ করা হয়ে থাকে তবে কোনো বিল প্রদান করা হবে না। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইউএনও মুনিয়া চৌধুরী বলেন, আমি এ উপজেলায় যোগদানের আগেই ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তবে এমনটা ঘটে থাকলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।