পাবনায় পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হলেও বাজার দর নিয়ে শঙ্কায় কৃষক
24, February, 2022, 6:40:26:PM
পাবনা প্রতিনিধি:
পাবনাকে বলা হয় বৈচিত্রময় কৃষির জেলা। এর মধ্যে পেঁয়াজের রাজধানীর খ্যাতি রয়েছে পাবনার সুজানগর ও সাঁথিয়ার। দু-চোখ যে দিকে যায় সেদিকেই বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে পেঁয়াজের সমারোহ। এছাড়াও হালি পেঁয়াজ (চারা থেকে উৎপাদিত) উৎপাদন হয় বেড়া, ফরিদপুর, সদরসহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। চলতি বছরে জেলায় পেঁয়াজের বাম্পার ফলে আশা করলেও কৃষকদের চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে আবহাওয়া ও বাজার দর।
এবার ফাল্গুনের শুরুতেই কয়েক দফা বৃষ্টি দেখা দিয়েছে। ফলে বালাইনাশক স্প্রে ব্যবহার করার পর বৃষ্টি হওয়ায় আবারও স্প্রে করতে হচ্ছে। এতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে তেমনি পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও কম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়াও বৃষ্টির কারণে পোকা মাকড়ের আক্রমণ, পেঁয়াজ গাছের গোঁড়া পচনসহ নানা রোগবালাই দেখা দিতে পারে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আবারও বৃষ্টির যে পূর্বাভাস রয়েছে তাতে চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা।
এবছর জেলায় পেঁয়াজের (হালি) আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৪৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে তাহেরপুরী, ফরিদপুরী, বারি পেঁয়াজ-১, কলসনগর, লালতীর কিং, হাইঃ লালতীর, হাইঃ ইস্পাহানী ও হাই মেটাল জাতের পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে, আর গত বছর আবাদ হয়েছিল ৪৪ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৫১৩ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সুজানগর উপজেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৫শ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর। এছাড়াও সাঁথিয়ায় ১৫ হাজার ৭শ এবং বেড়া উপজেলায় ৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে।
পাবনার সুজানগরের খয়রান, দূর্গাপুর, ভায়নার, সাঁথিয়ার খিদিরগাঁও, মটকা, ঘুঘুদহ, মুক্তারের মাঠ, আফ্রা গ্রামের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, পেঁয়াজের খেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। কেউ কেউ আগাছা তুলছেন, কেউ কেউ দিচ্ছেন বালাইনাশক স্প্রে, কেউবা করছেন বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি বের করতে নালা কাটতে।
খায়রান গ্রামের কৃষক আশরাফ আলী শেখ ও রওশন আলী বলেন, ‘ঘনঘন বৃষ্টি হচ্ছে। পোকা ধরে যাচ্ছে। আগাছা জন্মাচ্ছে। লেবারের দাম বেশি, সার-কীটনাশকেরও দাম বেশি। আর বৃষ্টি-বাদলের জন্য ফলন নিয়েও চিন্তায় আছি। বৃষ্টির কারণে দ্বিগুণ স্প্রে করতে হচ্ছে। আগাছা তুলতে লেবারও বেশি লাগছে। প্রতি বিঘায় ৫০ মণের ওপর পেঁয়াজ উৎপাদন হয়, এবার কত হবে তা বলা মুশকিল। এবার পেঁয়াজের যে বাজার মূল্য আর সার-বীজ-লেবার খরচ বাদ দিয়ে আমাদের পুশায় না। সরকার যদি এবার কৃষকের কথা চিন্তা করে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় তবে আমরা কিছুটা লাভের মুখ দেখতে পারি।’
এবার ২৫ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন দূর্গাপুরের চাঁদ আলী ম-ল। গতবার লাভের মুখ দেখলেও এবার দাম ও ফলন নিয়ে তিনিও চিন্তায় আছেন। তিনি বলেন, ‘গতবার বীজের দাম বেশি হলেও উৎপাদন ও বাজার দর ভালই পেয়েছিলাম, কিন্তু এবার কি হয় আল্লাহই ভালো জানেন। এবার মুড়ি কাটা পেয়াজের যে দাম গেল তাতে আমাদেও হালি পেঁয়াজের দাম কেমন হবে তা নিয়েই আশঙ্কায় আছি। এরপর আবার আবহাওয়ার অবস্থাও ভালো দেখা যাচ্ছে না।’
কৃষিতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ভায়না গ্রামের মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রামাণিক এবার পেঁয়াজ আবাদ করেছেন ২০ বিঘা। হতাশার জানিয়ে তিনিও বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে কীটনাশক খরচ ৩ হাজার টাকা, সার ও চাষ বাবদ ৫ হাজার টাকা। লেবার খরচ ১৫ হাজার টাকা। আর জমি লীজ নিতে হয় ২০ হাজার টাকা দিয়ে। সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ৪০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হচ্ছে। এবার এভাবে বৃষ্টি হলে ফলন হতে পারে ৩০-৪০ মণ। আর বাজার দর যদি ৭শ-৮শ বা হাজারের কাছাকাছি থাকে তাহলে লস হবে। আর ফলন ও দাম ভালো থাকলে কিছুটা লাভের আশা করা যায়।’
কৃষকদের দাবি, সরকার বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। কিন্তু এবার আমদানি কিছুটা কমিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে যদি হিমাগার বা সংরক্ষণাগারে রাখে তাহলে দেশের মানুষ ও কৃষকরাও ব্যাপক লাভমান হবে। দামও এভারে উঠা-নামা করতে পারবে না। তাই দ্রুত হিমাগার তৈরি করতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান তারা।
হতাশায় আছেন পেঁয়াজ চাষের শ্রমিকও। একাধিক শ্রমিক বলেন, ‘পেঁয়াজ লাগানোর সময় আমাদের মজুরি ছিল ৬-৭শ টাকা। এখন কমে ৪শ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর তেল-চালসহ বাজারে সবকিছুর মূল্য বাড়তি। দুই-তিন কেজি চাল আর এক লিটার তেল কিনলেই মজুরি শেষ। আমাদের এই মজুরি দিয়ে সংসার চালালো একেবারেই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার যদি পেঁয়াজের দাম একটু বাড়তি করে তাহলে গেরস্তোও লাভবান হয় আমরা লেবাররাও লাভ হই।’
তবে আশার বাণী শুনিয়েছেন সুজানগর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. রাফিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত যে পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে তাতে খুব বেশির ক্ষতি এখনও হয়নি। অসময়ে হালকা কিছু বৃষ্টিপাত হওয়ায় কৃষকদের কিছুটা বাড়তি আন্তঃপরিচর্ষা করতে হচ্ছে। এবার আমাদের কৃষি অফিস সার-বীজসহ অন্যান্য উপকরণ দিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করেছে। ফলনও আশা করছি ভালো হবে। তবে সামনে যদি আবহাওয়ার কোন দুর্যোগ দেখা দেয় তাহলে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়বে।’
ঈাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাজার মূল্য ভালো আছে। আমরা আশা করছি এই বাজার যদি অব্যাহত থাকে তবে কৃষকরা লাভবানই হবেন। আমরা কৃষিবিভাগ সর্বাক্ষণিক ভাবে কৃষকদের পাশে থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। কৃষকদের উৎপাদন ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন উপকরণ ও পরামর্শ দিয়ে আসছি। আশা করছি ফলনও ভালো হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার সংরক্ষণ করে আমরা সারা দেশে পাবনা থেকে পেঁয়াজ সরবরাহ করবো বলে আশা প্রকাশ করছি। এজন্য আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে সঙ্গে কথা বলেছি। তাতে পাবনায় অত্যাধুনিক সংরক্ষণাগার প্রতিষ্ঠা করা যায়।’