ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমনঃ বন্যা, নদীভাঙন, খরা,জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিক্ষয় আমাদের নিত্যসঙ্গী। নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি তো রয়েছেই। মানবসৃষ্ট নানা কারণে প্রাকৃতিক পানিচক্র বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। কমে যাচ্ছে পানির গুণগত মান ও প্রাপ্যতা। বাড়ছে লবণাক্ততা ও মিঠা পানির স্বল্পতা। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য বন্যা, খরা, সাইক্লোনের ঝুঁকি বাড়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করাও দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এমতাবস্থায় পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষি, মৎস, খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্প, বনায়নসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় বিবেচনায় রেখে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তার সমন্বিত পরিকল্পনা হচ্ছে ডেল্টা প্ল্যান বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। বাংলাদেশের মতো নেদারল্যান্ডসও একটি ব-দ্বীপ রাষ্ট্র। আমাদের মতো তারাও একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস একত্রে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে। শতবছরের মহাপরিকল্পনা বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চেয়ারপারসন করে ‘ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল’ গঠন করেছে সরকার। ১২ সদস্যের এই কাউন্সিল গঠন করে ১ জুলাই ২০১৮ গেজেট প্রকাশ করেছে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ। বন্যা, নদী ভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে বহু আলোচিত ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ পরিকল্পনাটি ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতে, আন্তঃদেশীয় পানিসম্পদ ব্যাবস্থাপনা, নৌপরিবহন স্যানিটেশন ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সব খাত বিবেচনায় রেখে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ অপরিহার্য ছিল। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গঠন করা হবে করা হবে ‘ডেল্টা তহবিল’। তহবিলের সম্ভাব্য উৎস বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী, পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কিত তহবিল। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিকেও (পিপিপি) বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গঠন করা হবে ‘ডেল্টা কমিশন’। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৭৮২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির ২.৫ শতাংশ পরিমাণ অর্থায়ন দরকার বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। খাদ্য নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ পানির নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই তিনটি বড় লক্ষ্যকে চিহ্নিত করে ডেল্টা প্ল্যানের ৬টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে: (১)বন্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, (২) বিশুদ্ধ পানির নিরাপত্তা এবং পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা, (৩) নদীর বর্ধিত অংশ ও নদীর মোহনার টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, (৪) জলাভূমি এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং এগুলোর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিতে প্রচার চালানো, (৫) অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃসীমান্ত জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান এবং ন্যায়সঙ্গত প্রশাসন গড়ে তোলা, (৬) জমি ও জলজ সম্পদের সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
পরিকল্পনাটি প্রণয়নে দেশের ৮টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলকে ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির মাত্রায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একই ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোকে অভিন্ন গ্রুপে বা হটস্পটে আনা হয়েছে। এভাবে দেশে মোট ৬টি হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো: উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল,পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা অঞ্চল এবং নগর অঞ্চল ও ক্রসকাটিং অঞ্চল (শেরপুর, নীলফামারী ও গাজীপুর জেলা)। এসব হটস্পটের পানিসম্পদ, ভূমি, কৃষি, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, খাদ্যনিরাপত্তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ভূ-প্রতিবেশ, নদীর অভ্যন্তরীণ ব্যবহার, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা, পলি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে পানির চাহিদা নিরূপণ ও সুপেয় পানি সরবরাহে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য ২৩টি প্রকল্প, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য ৯টি প্রকল্প, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য ৬টি প্রকল্প, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য ৮টি প্রকল্প, নদী ও মোহনা অঞ্চলের জন্য ৭টি প্রকল্প, নগর অঞ্চলের জন্য ১২টি প্রকল্প আর ক্রসকাটিং অঞ্চলের জন্য ১৫টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট ১৯টি সহায়ক গবেষণাপত্র তৈরি করা হয়েছে, যার আলোকে একটি জ্ঞানভান্ডার গড়ে তোলা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও নগরায়ন বিবেচনা করে ভবিষ্যতের বিভিন্ন রূপকল্প বিবেচনায় শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ বর্ষা মৌসুমে বন্যা ব্যবস্থাপনা, পানি ও ভূমির লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণসহ পানিসম্পদ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমাদের ডেল্টা প্ল্যানকে আরও সুপরিকল্পিতভাবে সমন্বিত করা প্রয়োজন। বাস্তবসম্মত টেকসই উন্নয়নের মূলনীতি বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে।