বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে ষাটের দশকে। তবে সত্তরের দশকের শেষের দিকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্পখাত। পোশাক শিল্প তৈরি পোশাক বা আরএমজি (Ready Made Garments) নামে সমধিক পরিচিত। সুবিন্যস্ত কারখানায় বৃহদায়তনে ব্যাণিজ্যিক ভিত্তিতে পোশাক উৎপাদনের ঘটনা বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত নতুন। ষাটের দশকের শুরু পর্যন্ত ব্যক্তি উদ্যোগে ক্রেতাদের সরবরাহকৃত এবং তাদেরই নির্দেশিত নকশা অনুযায়ী স্থানীয় দর্জিরা পোশাক তৈরি করতো। শুধুমাত্র শিশুদের জামাকাপড় এবং পুরুষদের পরিধানযোগ্য গেঞ্জি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশক পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজারও ছিল না বললেই চলে। সত্তরের দশকের শেষার্ধ থেকে মূলত একটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজারও দ্রুত সম্প্রসারিত হয় এবং এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের আয় বৃদ্ধি পায় ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন আসে। খাতটি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এবং তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য মোট রপ্তানিতে ৫০% অবদান রেখে রপ্তানি আয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। আশির দশকের শেষার্ধে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আয়কে অতিক্রম করে পোশাক শিল্প রফতানি আয়ে প্রথম স্থানে চলে আসে। ১৯৯৯ সালে এই শিল্পখাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয় ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি লোকের, যার শতকরা প্রায় ৮০ জন মহিলা। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সাথে সাথে বস্ত্র, সুতা, আনুষাঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেটজাতকরণের উপকরণ ইত্যাদি শিল্পেরও সম্প্রসারণ হতে থাকে। এতদ্ব্যতীত পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্সুরেন্স সেবার চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সবটাই অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। এ ধরনের নতুন পরোক্ষ-কর্মসংস্থান মূলত পোশাক শিল্প কর্তৃক সৃষ্টি যার সুবিধাভোগী মোট ২,০০,০০০ শ্রমজীবী।
তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণ বাংলাদেশের সমাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেছে। পরোক্ষভাবে এই যে সেবাখাতে প্রায় আড়াই লাখের মতো মানুষের কর্মসংস্থান হয়। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও তৈরি পোশাক শিল্প সাড়ে ২২ লাখ নারী শ্রমিকের জীবনযাত্রার লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধন করেছে এবং তারা অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। শ্রমজীবী নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম হয়েছে, আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের কারণে এসব নারী শ্রমিকের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। চাকরির সুবিধাদি ভোগকারী, বাবা, ভাই এবং স্বামীর ঐতিহ্যগত পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করেছে। অধিকাংশ শ্রমজীবী নারী এখন বিয়ে এবং সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও অংশ গ্রহণ করতে পারছে। সমাজের বাল্যবিবাহ কমেছে, সেই সাথে হ্রাস পেয়েছে জন্মহার। শ্রমজীবী মেয়েরা তাদের ছোট ছোট ভাইবোনদের যত্ন নিচ্ছে এবং স্কুলে পাঠাচ্ছে। ফলে দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তৈরি পোশাক শিল্পখাতের সম্প্রসারণ নতুন উদ্যোক্তাদল সৃষ্টি করছে যারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বেসরকারি খাত গড়ে তুলেছে। এই উদ্যোক্তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা নারী। বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা ` বৈশাখী ` ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একজন নারী। বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানায় অনেক নারী ঊর্ধ্বতন নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত।
শুরুতে এই শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প সম্পূর্ণভাবেই আমদানিকৃত কাঁচামাল নির্ভর ছিল। এই নির্ভরশীলতার কারণে পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশি মালিকেরা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয় এবং পরিস্থিতির উন্নতি হয়। স্থানীয় উদ্যোগত্তারা পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্পের বিকাশ ঘটায় এবং স্থানীয়ভাবেই দক্ষতা বৃদ্ধি করে মানসম্পন্ন রপ্তানিযোগ্য সুতা ও কাপড় উৎপাদন শুরু করে। দ্রুত পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প গড়ে ওঠার কারণে এই শিল্প আর আগের মতো কাঁচামাল আমদানির উপর নির্ভরশীল নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক বৃহৎ বহুস্তরবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। এ সমস্ত কারখানা সুতাকাটা, বয়ন, রং,প্রক্রিয়াজাত এবং ক্যালেন্ডারিংসহ অন্যান্যকাজ সম্পন্ন করে। তাছাড়া এ সমস্ত রপ্তানিযোগ্য কাপড় স্থানীয় কারখানায়ও বিক্রি হয়। এই কারখানাসমূহে বিদেশি ক্রেতাদের নকশা অনুযায়ী কেটে মোড়কে ভরে নির্ধারিত ক্রেতাদের কাছে পাঠানো হয়। পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প গড়ে উঠার ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান পূর্বের তুলনায় আরও সংহত হয়েছে।
কম উৎপাদন খরচের কারণেই বাংলাদেশ বিদেশি ক্রেতার কাছে ক্রমবর্ধমান আকর্ষণীয় ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। কম খরচের সুযোগ গ্রহণ করতেই তারা বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরবরাহকারী ঋণ সহায়তা বৃদ্ধি করে। এত কিছু সত্ত্বেও নতুন কারখানাসমূহ চলতি পুঁজির জন্য প্রচন্ড সমস্যায় পড়ে। এই সময় ব্যাক- টু- ব্যাক এল.সি (লেটার অব ক্রেডিট বা আস্থাপত্র) লেনদেনের জন্য উদ্ভাবিত নতুন পন্থার অবদানে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। ব্যাক- টু- ব্যাক এল.সি চলতি মূলধনের সমস্যা লাঘব করে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য মানসম্পন্ন কাপড় আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করেছে।