সময় তার নিজের গতিতে বয়ে যায়। সব কিছু শুরু হয় এবং শেষ হয়ে যায়। দিন যায় রাত আসে, রাত যায় দিন আসে। এভাবে শেষ হয় সপ্তাহ, মাস ও বছর। এ সময় ও কালের প্রবাহ কখনও থামে না। আপন গতিতে চলে সম্মুখপানে অবিরাম। সদা সচল সময়ের স্রোতধারা। বর্তমান বিলীন হয়ে যায় অতীতের বুকে। ভবিষ্যৎ ঠাই পায় বর্তমান প্রাঙ্গণে। আগমন ঘটে নতুনের, প্রস্থান ঘটে পুরানের। জগতে এটা চরম সত্য।
জাগতিক এই নিয়মেই আমাদের সকলের জীবন থেকে চলে গেল একটি বছর। হিজরী বর্ষ ছিটকে পড়ল মহাকালের অসীম গর্ভে। মিশে গেল সময়ের আবর্তে। শুরু হল একটি নতুন বছর। তথা আরবী বা হিজরি বর্ষ। হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। শব্দটি আরবী। যার আভিধানিক অর্থ সম্মানিত। বাস্তব বিচারেও এ মাস প্রতিটি মুমিনের দৃষ্টিতে সম্মানিত। প্রথমত পবিত্র ইসলামের আলোকিত বিশ্বাস ও বিধি বিধানকে আল্লাহর জমিনে পরিপূর্ণরুপে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নিজের মাতৃভূমি পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন, সহ্য করেছেন কত জুলুম নির্যাতন। পশ্চিমাকাশের এক ফালি মহররম চাঁদ চির জীবন্ত ত্যাগ ও আদর্শেও সেই বার্তায় আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায় প্রতিটি মুমিনের হৃদয় অনুভবে।
অধিকন্তু পবিত্র এ মাস আলোকিত হয়েছে প্রিয় সরদারে দু’আলম রাসুলে আরাবি (সাঃ) এর বরকতপৃর্ণ - সিয়াম সাধনায়। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বর্ণনা করেন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- রমজানের পর সর্বাধিক ফযিলতপৃর্ণ রোযা হল আল্লাহর মাস মহররমের। হাদিসে বর্ণিত মহররমের রোযাটি মূলত দশই মহররম তথা আশুরার রোযা। মহররমের মর্যাদা ও বরকতের উৎসও এ রোযাটি।
হযরত আবু কাতাদাহ (রাযি.) এর বর্ণনায় আছে আশুরার রোযা সম্পর্কে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেসা করা হলে তিনি বলেন- আশুরার রোযা বিগত বছরের পাপসমূহ মোচন করে দেয়। ইসলামে আশুরার রোযার সূচনা কিভাবে হল এ সম্পর্কে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হল, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনায় এসে ইহুদিদের দেখলেন, তারা আশুরার দিনে রোযা রাখে। তখন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের রোযা? তারা বললেন এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে পরিত্রাণ দিয়েছেন। তাই হযরত মূসা (আ.) এ দিনে রোযা রেখেছেন। তখন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তো মূসাকে অনুসরণের ক্ষেত্রে তোমাদের চাইতেও অধিক হকদার। এ সম্পর্কে আরো কিছু বর্ণনা রয়েছে যা একথা প্রমাণ করে যে, আশুরার রোযার প্রচলনটা এসেছে ইহুদি কিংবা হযরত মুসা (আ.) থেকে।
অথচ উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, কুরাইশরা জাহেলী যুগে আশুরার দিনে রোযা রাখত এবং রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও রোযা রাখতেন। হিজরত করে মদীনায় আসার পরও তিনি এ রোযা রেখেছেন এবং মুসলমানদেরকেও রোযা রাখতে আদেশ দিয়েছেন। তারপর যখন রমযান মাসের রোযা ফরজ হল তখন তিনি ইরশাদ করলেন, যার খুশি আশুরার রোযা রাখবে আর যার খুশি ছেড়ে দিবে। বোঝা গেল, আশুরার রোযা রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় থাকতেই রাখতেন। তবে মদীনায় এসে যা হয়েছে তা হল সাহাবিদেরকেও রাখতে বলেছেন। তাই এটাকে পূর্ব আমলেরই নবায়ন বলা যায় সূচনা নয়।
এখন প্রশ্ন হলো আশুরার রোযা কয়টি? তার জবাব হল আশুরার সুন্নত রোযা দুটি। রোযা রাখার পদ্ধতি হল মহররমের নয় ও দশ তারিখ কিংবা দশ ও এগার তারিখ। আশুরার প্রকৃত ফজীলত ও গুরুত্ব বিশুদ্ধ হাদীসের আলোকে এতটুকুই যা আলোচিত হল। শিয়াদের শোক মিছিল ও মাতমের সঙ্গে এর কোনোই সম্পর্ক নেই। এমনিভাবে হালুয়া রুটি বিতরণেরও কোন ভিত্তি নেই। এসব গর্হিত কাজ পরিহার করে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাতানো পদ্ধতিতে রোযা পালনের মাধ্যমে বরকতময় এ দিনের সুফল লাভ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সে তাওফীক দান করুন। আমীন
লেখকঃ শিক্ষার্থী জামিয়াতুন নূর আল কাসেমীয়া, উত্তরা ঢাকা।