পথশিশুরা সাধারণত টোকাই নামেই পরিচিত। জন্মগতভাবে কেউই পথশিশু বা টোকাই নামে পরিচিত না বা টোকাই নামে জন্মগ্রহণ করে না। এই শিশুদের পথশিশু বা টোকাই নামের পিছনে লুকিয়ে থাকে দীর্ঘ কাহিনী। এই পথশিশুরা বেশির ভাগই তৈরি হয় পারিবারিক কলহের কারণে। বাবা মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ, সংসারে অতিরিক্ত অভাব, বাবা-মায়ের দূরারোগ্য ব্যাধি কারণে শিশুরা অল্প বয়সে রাস্তায় নেমে আসে। আবার কখনোও দেখা যায় যে শিশুদের চুরি করে নিয়ে এসে রাস্তায় ছেড়ে দেয় ভিক্ষা করে অর্থ উপার্জনের জন্য। অনেককে এ কাজে বাধ্য করা হয়, অনেক অবৈধ সন্তানও বড় হয় যারা হচ্ছে টোকাই বা পথশিশু। তাদের থাকা, খাওয়া, ঘুমানোর কোনো জায়গা থাকে না। তারা রাস্তায়, পার্কে, বাস স্টেশন, রেল স্টেশন বা খোলা কোনো জায়গায় থাকে। তবে এদের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। পথেই কাটে তাদের সারাটা জীবন।
আবার পথশিশুদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত হয়ে যায় এবং মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে অসুস্থ হয়ে তারা রাস্তাতেই মারা যায়। আবার কেউ পাচারের শিকার হয়ে যায়। যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিক্রি করে দেয়া হয় এবং নির্যাতনেরও শিকার হয়ে থাকে। যারা মেয়ে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এবং যৌনকর্মী হতে তাদেরকে বাধ্য করা হয়।
বর্তমান করোনাকালীন সময়ে পথশিশুদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লকডাউন থাকার কারণে রাস্তায় লোকজনের চলাচল কমে যাবার কারণে তাদের আরো বেশি অসুবিধা হচ্ছে, ঠিকমতো খেতেও পারছে না। কারণ পথশিশুদের একটা বিরাট অংশ ভিক্ষা করে খায় আবার কিছু অংশ ফুল, বেলুন, চকলেট ইত্যাদি বিক্রি করে চলে। লোকজন কম থাকার কারণে তারা এসব করতে পারছে না। অনাহারে চলছে তাদের জীবন।
করোনা কালীন সময়ে বা অন্যান্য যে কোনো সময়ে আমরা দেখতে পাই কিছু পথশিশু তাদের মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে বা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে। তারপর সেখান থেকে তাদের জীবন পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। তারা সরকারি ভাবে এমনকি বেসরকারিভাবেও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু অন্যান্য পথশিশু যারা ভাইরাল হচ্ছে না তাদের কথা কেউ ভাবছে না। তারা কোনো সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছে না। তাদের জীবনের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তার কোনো খবর কেউ রাখছে না। তাদের জন্যও প্রয়োজন স্থায়ীভাবে কোনো কিছু করা, তাদের সুষ্ঠু জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা। তারাও সমাজের অন্যদের মতো মানুষ। পথশিশু ভেবে তাদেরকে অবহেলা অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। পথশিশুদের পূণর্বাসন ও জীবনমানের উন্নয়ন যত তাড়াতাড়ি করা যাবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলকর হবে। কারণ প্রতিনিয়ত পথশিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর এই বিরাট সংখ্যক পথশিশু জাতির জন্য হুমকিস্বরুপ হতে পারে। তাই সরকারকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে এ বিরাট অংশ জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ না হয়ে আশির্বাদ হয়ে দাঁড়ায়।
তবে ঢাকা শহরে অনেক বেসরকারি এবং কিছু সরকারি উদ্যোগ আছে এই পথশিশুদের জন্য। কোনো সংগঠন তাদের খাবার দিচ্ছে, পোশাক দিচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছে আবার অনেক সংগঠন তাদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও করে থাকেন। তবে দিনশেষে তাদের আবার সেই পথেই নামতে হয়। কারণ এসকল উদ্যোগগুলোর কোনোটাই টেকসই নয়। এভাবে কাজ করলে পথশিশুদের কোনো উন্নতি করা যাবে না। কারণ তাদের প্রয়োজন শিক্ষা, থাকার স্থায়ী জায়গা, খাবারের ব্যবস্থা সর্বোপরি তাদের প্রয়োজন হচ্ছে মৌলিক চাহিদা। আর বর্তমান মহামারীর সময়ে তাদের চাই নিরাপত্তা। সরকারকেই তাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। একমাত্র সরকারের তত্ত্বাবধানেই পথশিশুদের জীবন বদলে যেতে পারে এবং তাদের জীবনের উন্নতি হবে। দেশের কল্যাণের জন্য হলেও পথশিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। তাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই এ সম্পর্কে সরকারকে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক ঃ কবিতা রাণী মৃধা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।