প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চা
23, October, 2020, 2:26:12:PM
অদৃশ্য এক অণুজীব নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় সারাবিশ্ব আজ আতঙ্কিত, জনজীবন বিপর্যস্ত, স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্থগিত, অফিস-আদালতের কাজে গতিহীনতা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পুরো অর্থনীতির চাকো যেন থমকে দাড়িয়েছে। এমন সময় “মরার ওপর খাঁড়ার ঘা”এর মত আমাদের দেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে আরেক ভয়াবহ ও জঘন্যতম ব্যাধি -ধর্ষণ।
পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের খবর, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবকিছুতেই দেখতে পাই ধর্ষণ, গণধর্ষণ, শিশুধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতামূলক নানাবিধ আচরণ। ইদানীং দেশে ধর্ষণ যেন এক নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। সংবাদপত্র খুললেই চোখে পরে প্রতিদিন ৪-৫টা ধর্ষণের খবর। সারাদেশে প্রায় অবাধে ঘটে চলছে এ নৃশংস অপরাধ। শেষ কোথায় এ জঘন্যতম অপরাধের? এর কি কোনো শেষ নেই?
ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, স্কুল কলেজ মাদ্রাসাসহ সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র- কোনো জায়গাতেই আজ নারীরা নিরাপদ নয়। পশুর চেয়ে হিংস্র ও বর্বর একদল হায়েনা তাদের যৌনক্ষুধা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নারীদের চারপাশে। নারী মাত্রই যেন তাদের যৌান ক্ষুধা মেটানোর মাধ্যম। ভোগের লালসায় উন্মাদ এসব পশুদের বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোনো বয়সী নারী ও কন্যাশিশু। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সাথে বেড়াতে গেলে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধুকে বখাটে শিক্ষার্থীদের দলবেঁধে ধর্ষণ, ডাকাতি করতে এসে ঘরে ঢুকে প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণ করা হয় খাগড়াছড়িতে, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলীতে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ৩৭ বছর বয়সী গৃহবধুকে বিবস্ত্র করে বর্বরযুগীয় উপায়ে নির্যাতন, ২০১৬ সালে কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সোহাগী জাহান তনু নামের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা, এসব ঘটনা আমাদের আতঙ্কের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, মনসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে দিন দিন। নারীর নিরাপত্তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নারীরা কি আদৌ নিরাপদ? কোথায় আসলে নারীদের নিরাপত্তা?
আফসোসের বিষয় ধর্ষণের জন্য ধর্ষককে দায়ী না করে বরং দায়ী করা হচ্ছে ধর্ষণের শিকার নারীকে, তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা, মেলামেশাকে। একশ্রেণীর মানুষ নারীর পোষাককে দায়ী করছে ধর্ষণের জন্য। আদতে ধর্ষণের সত্যতা যাচাইয়ে পাওয়া যায় না যে ধর্ষণের জন্য পোষাক ই দায়ী। পোষাক ই যদি ধর্ষণের জন্য দায়ী হয়, তবে কেন ২ বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়? কেন ওযু করতে বেরিয়ে ৭২ বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়? মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে কেন ধর্ষণ করা হয়? মানসিক ভারসাম্যহীন রাস্তার ধারে থাকা অসুস্থ মেয়েটিকেও কেন ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে? এসব ঘটনার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই পোষাক দায়ী নয়। বরং যারা ধর্ষণের জন্য পোষাকরে দোহাই দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন, তারা ধর্ষণের জন্য প্রকৃত দোষী ধর্ষককে দায়ী না করে, ধর্ষণের প্রতিবাদ না করে, ধর্ষিতার প্রতি সহযোগী মনোভাব পোষণ না করে ধর্ষণের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিতে ভুমিকা পালন করছেন, পরোক্ষভাবে ধর্ষকদের উৎসাহিত করছেন। নারীর পোষাকের দোহাই দিয়ে তাকে ধর্ষণ করার অধিকার কারো নাই।
ভয়াল এ কালো মিছিলের ইতি টানতে প্রয়োজন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে, বদলে যেতে পারে ক্রমবর্ধমান এ ধর্ষণের চিত্রও। মেয়েরা একা কোথায় যেতে পারবে না, সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে পারবে না, ছেলে বন্ধুদের সাথে মেশা যাবে না, যাচ্ছে তাই পোষাক পরিধান করা যাবে না, সর্বোপরি মেয়েরা ছেলেদের মত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে না বলে যেসব বিশ্বাস আমাদের সমাজে বদ্ধমূল হয়ে আছে, সেসব বিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে নারী-পুরুষ উভয়ের সম-অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পরস্পরের প্রতি সহর্মমিতা, পারস্পারিক সৌাহার্দ্য, সহযোগী মনোভাব বাড়াতে হবে।
পরিবার থেকে ছেলে মেয়ে উভয়কে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। পরিবার ও সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। কোনো ধর্মেই অপরাধকে ছোট করে দেখা হয় না। ধর্ষক যে ই হোক না, হোক কোনো ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা বিত্তবান কেউ বা দলীয় পরিচয়ধারী কেউ, ধর্ষক মাত্রই দ্রুত আইনের আওতায় এনে সুষ্ঠ বিচারব্যবস্থার অধীনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত ও কার্যকর করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করে সকল মানুষের জন্য আইন সমানভাবে নিশ্চিত করতে হবে। আইনী সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধর্ষিতা নারী যেন কোনো ধরণের হয়রানির শিকার না হয়ে সুবিচার পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
তাছাড়া মেয়েদের আত্মরক্ষার মৌলিক কৌশলগুলো শিখে রাখা উচিত যেন কোনো পরিস্থিতে নিজের নিরাপত্তা নিজেই নিশ্চিত করতে পারে।
পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চাও ধর্ষণের মত সামাজিক ব্যাধিকে রুখতে সহায়তা করবে। নারীকে ভোগ ও লালসা পূরণের সামগ্রী হিসেবে না ভেবে একজন মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শিখতে হবে। পরিবার থেকেই যৌনতা বিষয়ক শিক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌনতা নিয়ে প্রচলিত ট্যাবু দূরীকরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে যৌনতা বিষয়ক শিক্ষা প্রদান করতে হবে। যৌনতা বিষয়ক শিক্ষার অভাবও পরোক্ষভাবে ধর্ষণকে প্রভাবিত করে। যৌনতা এক ধরণের সহজাত প্রবৃত্তি। সব ধরনের প্রাণীর ই এ প্রবৃত্তি বিরাজমান এবং যৌন চাহিদা পূরনের বৈধ উপায়ও রয়েছে। আর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- ধর্ষণ কখনো যৌনতা পূরণ করতে পারে না। এটি শুধু ক্ষমতাসীনতা, অসুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক ও বিকৃত কামপ্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ।
সর্বোপরি কঠোর আইনের যথাযথ প্রয়োগ, ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত ও দ্রুত কার্যকর করা, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধ চর্চা দ্বারা ধর্ষণ নামক ব্যাধির একেবারে নির্মূল সম্ভব না হলেও তা অনেকাংশেই কমে যাবে এবং সুস্থ সমাজ গঠিত হবে।
তানভীন সুইটি অর্থনীতি বিভাগ ৩য় বর্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।