মোমেনা আক্তার
পাশাপাশি বেঞ্চে আমরা, আমি আর সুভা। সুভা খুব ভালো বন্ধু হলেও আমার খুব হিংসে হতো, কারণ ক্লাসে নম্বর পাওয়াতে সে ছিল একমাত্র আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। এক-দু নম্বর কম পেলেই কান্না শুরু করে দিতো। আমি অবশ্য কান্না করতাম না, মনে মনে জেদ চাপতাম পরেরবার আরও বেশি পেতে হবে। এমনি ছিলো আমাদের ছোটবেলার দিনগুলো। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কেজি স্কুলে পড়ে আমি ভর্তি হই হাই স্কুলে আর ও ভর্তি হয় গার্লস স্কুলে। স্কুলের মধ্যে দুরত্ববেশি না হলেও সেই আগের মতো আর দেখা হয় না। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রায় ৩ বছর পর হঠাৎ ওর সাথে দেখা, একই স্যারের কাছে গণিত প্রাইভেট পড়তাম। বললাম,‘ওমা! সুভা নাকি? তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না, বড় হয়ে গেছো!’
মনে হয়, আমার কথাতে বেশ লজ্জা পেয়েছে। কোনো জবাব না দিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। পরদিন আবার দেখা, এখন কিছু না বলে আড় চোখে স্যারকে ফাঁকি দিয়ে ওকে দেখতাম। সুভা বেশ মনোযোগ দিয়ে অংক বুঝে নিচ্ছে চোখ পড়তেই আমি স্যারের দিকে তাকাই আর ভাবি, যে মানুষ ক্লাসে কথায় খই ফুটাতো, আজ এত নিশ্চুপ। এই সুভাকে এতদিন ভুলে গিয়েছিলাম! প্রাইভেট শেষে ও ডাকলো, ‘শুনেন, কেমন আছেন?’ নিচু গলায় বলে।
-সুভা, তোমার সাথে তো গতকাল কথা বলতে চেয়েছিলাম, কথা বললে না। -না, আমি এমনিতেই ছেলেদের সাথে কম কথা বলি, হঠাৎ করে দেখছি তো চমকে গিয়েছিলাম।
ওমা! এ কেমন কথা! ৫ বছর একসাথে থাকলাম, আরও কত কথা কাটাকাটি হয়েছে, হয়েছে রাগ অভিমান। তুমি ছেড়ে তুই বলেছি আমরা। আর এখন ও বলে আপনি! আমি এত অচেনা হয়ে গেলাম? নাহ্, আমি ঠিক আছি, সুভা একদম পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেদিন বেশি কিছু বলা হয় নি, তাড়া দেখিয়ে চলে যায় ও। সে যাক গে, আমি এত ওকে নিয়ে ভাবছি কেন! ও থাকুক ওর মতো। প্রাইভেটে একটু একটু করে কথা হয় আমাদের। কয়েকদিন পর অনেকবার বলে আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে। পড়াশোনার তেজ আগের মতোই আছে কিন্তু বান্ধবী আর ছেলের মধ্যে আমি ছাড়া আর কারও সাথে কথা বলতে দেখি না। যাক, এটাও ভালো।
আজকালের ছেলেমেয়েরা যে দুষ্টু, কোনো ফাঁদে না পড়ার জন্যে এমন থাকাই ভালো। আমিও দরকার না হলে কথা বলি না, কিন্তু ও আর পিছিয়ে গেলো না। আমাদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হতে লাগলো। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় সুভা ট্যালেন্টপুল আর আমি সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাই। ওর প্রতি হিংসাটা যেমন বাড়লো, ভালো লাগাটাও কম ছিলো না। নবম শ্রেণিতে ওকে আমাদের স্কুলে ভর্তি হতে বলি, কিন্তু ওর আর ওখানে থাকা হলো না। ওর বড় ভাই ঢাকায় থাকে, ওকে ঢাকায় ভর্তি করে দিবে। শুনে খুবই খারাপ লাগে, কি যেন হারিয়ে ফেললাম! কিছু করার নেই। ঠেকাতে পারবো না তো।
আবার ৭ বছর পর দেখা সুভার সাথে! এবার সুভাই আমাকে চিনে ফেলেছে, ‘মাহমুদ তুমি এখানে! কবে আসছো? অনেকদিন পর দেখা।’ এবার আবাক হই আরও বেশি। ওর মধ্যে অকল্পনীয় পরিবর্তন, কথা বলছিলাম না দেখে আবার বললো, ‘মাহমুদ, আমাকে চিনছো? আমি সুভা।’
-ওহ্, সুভা! আমি তো আনেক আগে এসেছি, এখানেই পড়ি। হিস্টোরি থার্ড ইয়ার। তোমার খবর কী, বলো? তুমি এখানে! তুমি ঢাবিতে পড়! আমিও তো, বিবিএ ফিন্যান্স থার্ড ইয়ার। আমার ভাই থাকে মোহম্মদপুরে ওখানেই থাকি। বাহ্, আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, তাও কতদিন পর দেখা!
টিএসসিতে বসে চা খেতে খেতে আরও কিছুক্ষণ গল্প করলাম। আমি যতই ওকে দেখি, ততই মুগ্ধ হই। এক সুভার এত বৈচিত্র্য! সময় আর পরিবেশ মানুষকে কী না করতে পারে? মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে দেখা হয়ে যায়। সময় মিললে কখনও বা ওকে নিয়ে ঘুরতে যাই শহীদ মিনার বা পুরান ঢাকার ওদিকে। পুরান ঢাকার বিরিয়ানি খাওয়াতো সে, আর গল্প করতো, নানান রং-বেরং এর গল্প, তার গল্পের চেয়ে গল্প বলার ধরণ ছিলো খুবই আকর্ষণীয়। যে কেউকে মুগ্ধ করতো। গান গাইতো, আবৃত্তি, অভিনয়, উপস্থাপনা; এতকিছু সে কবে শিখলো!
সাবেক রুমমেট বড় ভাই ফরেন ক্যাডার হলেন। উনার মতো ক্যাডার হতেই হবে। উনার অনেক কষ্টের গল্প শুনেছি। পড়া ছাড়া কিছু বুঝেন না। আজ থেকে উনার মতো করে এগোবো আর সুভাকে ভালোবাসার কথাটা বলে ফেলবো। আমি জানি, ও আমাকে পছন্দ করে, তা না হলে এত ছেলে বাদ দিয়ে আমাকে এত সময় দিবে কেন! তাছাড়া ও আমাকে ছোটবেলা থেকেই চিনে। নিশ্চয় আমাকে নিয়ে ভাবে। ওকে নিয়ে আমার অন্যরকম অনুভূতি হয়।
ফরেন ক্যাডার ভাই এর বিয়ে ঠিক হলো। হ্যাঁ, আমিও ওমন ক্যাডার হয়ে সুভাকে বিয়ে করে ফেলবো। ভাবতে ভাবতেই সুভার ফোন কল, ‘কী করো? একটা সুখবর আছে।’
-কী সুখবর? শুনো,আজ বিকেলে ক্যাম্পাসে আসো কথা আছে। -না, আজ পারবো না। শুনো, পরশু দিন আমার বিয়ে কেনা-কাটা, ঝায়-ঝামেলা আছে অনেক, তোমাকে আসতে হবে কালকে। ছেলে ফরেন ক্যাডার, ঢাবির স্টুডেন্ট, বিবিএ, এমবিএ করেছে। ভাই সময় নিচ্ছে না। তুমি কাল সকাল ৯ টায় চলে আসো...। মনের অজান্তে বলে ফেললাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ। হ্যাঁ, যাবো।’
আমার রুমমেট ভাই এর বিয়ে যেতে তো হবেই। রুমের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে গেলেন। দেখি, এ জীবন আরও কতদূর যায়, চলুক জীবন জীবনের মতো।
লেখক : শিক্ষার্থী-শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
স্বাধীন বাংলা/এআর
|