রবিবার, ৮ ডিসেম্বর 2024 বাংলার জন্য ক্লিক করুন
  
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|

   সম্পাদকীয়
  আত্মহত্যা ও বিবিধ আলোচনা
  22, August, 2020, 12:16:41:PM

ইকবাল হাসান:
একজন মানুষের জন্ম এই পৃথিবীর কোথায় হবে এটা যেমন সে ঠিক করতে পারে না তেমনি কখন তার মৃত্যু হবে সেটাও সে ঠিক করতে পারে না। যদি সে  তার মৃত্যু ঠিক করে ফেলে সেটা আত্মহত্যার মাধ্যমেই শুধু সম্ভবত। বিভিন্ন ধর্মে আত্মহত্যা নিয়ে অনেক কিছুই বলা হয়েছে। সবাই এটাকে নিরুৎসাহিত করলেও সময়ের পরিবর্তনে বেড়েই চলছে।
একজন ব্যক্তি নিজেকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত কোন পর্যায়ে নিতে পারে সেটা একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন! কিন্তু কিছুটা ধারণা রয়েছে! আমরা যখনই কোন জিনিসের ভালো দিক এবং খারাপ দিকগুলো আলাদা করতে পারি তখনই ওই জিনিসকে ভালোবাসতে শিখি। আমরা একটা মাছের কথা উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারি। মাছ একজন ভোক্তার কাছে তখনই প্রিয় হবে যখন সে মাছের মাংস থেকে কাঁটা আলাদা করতে পারবে, বুঝতে পারবে কোনটা খেতে পারবে কোনটা খেতে পারবে না। তেমনি কাউকে ভালোবাসা, বিশেষত নিজেকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে নিজের  ভিতরের কোনটা ভুল, কোনটা সঠিক যখন বুঝতে পারবে কেউ তখন সে নিজের গুরুত্ব নিজের কাছে অনুধাবন করতে পারবে। যদি এরকম না হয় তাহলে কোনটা খাবারের যোগ্য কোনটা খাবারের যোগ্য না বুঝতে পারবো না; নিজের ভিতরে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ বুঝতে পারবো না; তখন নিজেকে একজন আপাদমস্তক খারাপ মানুষ বলেই মনে হবে। তখনই মানসিক অবসাদ এসে মনের দরজায় ধাক্কা দেয়। স্বাভাবিকভাবে, কখনো কখনো আমরা ভালো-মন্দ বুঝতে পারবো না তখন সেই ছোটবেলার মতো বাবা-মা-ই যদি আবার শিক্ষকের ভূমিকায় আসে তাহলে আমরা আবার নিজের গুরুত্ব নিজের কাছে ফিরে পাবো। এক্ষেত্রে, বাবা-মার জায়গায় যে কেউ হতে পারে।
জীবনের সফলতার মাঝে ব্যর্থতা আসবে, এটা চিরন্তন সত্য। অনেক সময় ব্যর্থতা আমাদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ করিয়ে দেয়। কোনটা নিজের জন্য ভালো হবে, কোনটা মন্দ হবে সেটাই বুঝতে পারি না। লোকিক একটা কথা আছে, ‘পাগলেও নিজের ভালো বুঝে।’ অর্থাৎ, ব্যর্থতা আমাদের অনেক সময় পাগল কিংবা তারও নীচের কাতারেই দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন যদি কেউ কাঁধে হাত রেখে ভরসা দেয়, বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব যদি পাশে এসে দাঁড়ায় নতুন করে সাহস পাওয়া যায় বাকি থাকা জীবনটা বাঁচতে। কিন্তু সমস্যাটা এখানেই! এই ব্যর্থ সময়ে, দুঃসময়ে কাছের মানুষগুলোকে পাওয়া যায় না, যাদের কাছে  নিঃসংকোচে সবকিছু বলে দেয়া যায়। কারণ, মিথ্যা এই পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই মিথ্যা। বেশিভাগ মানুষই আজীবন প্রকৃত বন্ধু পায় না, ঘিরে থাকে দুধের মাছি দিয়ে। যখনই দুঃসময় আসে তখন দুধের মাছি উড়াল দিতে পারলেও দুধের মালিক  দুধটুকু আর ফেলে দিতে পারেন না। তিনি তার কষ্ট করে কামানো মানসিক অবসাদে কেনা দুধটুকু একটু একটু করে খেতে থাকেন আর মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকেন।
মানুষের এই অবস্থাকে বলা হয় ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদগ্রস্ততা। সে সময় একজন কাছে মানুষের খুব প্রয়োজন। নিজের সকল ক্লান্তি, নৈরাশা দূর করতে একটা বিরতি দরকার সেই বিরতি না পেয়ে একজন চূড়ান্ত বিরতিতে যাওয়ার পরিকল্পনায় মগ্ন হয়।
এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ৩৯ দশমিক ৬ জন আত্মহত্যা করে। মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন এর মধ্যে ডিপ্রেশন, ব্যক্তিত্বে সমস্যা, গুরুতর মানসিক রোগ বা স্বল্পতর মানসিক রোগ। তাছাড়া মাদকাসক্তি, এনজাইটি, অপরাধ বোধ, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহ, প্রেম-কলহ, অভাব অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা, যৌন নির্যাতন, মা-বাবার ওপর অভিমান, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট, প্রেমে ব্যর্থ ও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করেন। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে কারণ থাকে অজানা।
সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা সংঘটিত হয় ডিপ্রেশন বা বিষন্নতার জন্য। ডিপ্রেশন একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি যা একজন মানুষকে সবার অজান্তে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় তিনশ মিলিয়ন ডিপ্রেশনের রোগী রয়েছেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ৫ জনের ১ জন মানুষ কোনো না কোনো ধরনের ডিপ্রেশন বা এনজাইটিতে ভুগছেন। বিশ্বের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মৃত্যুর প্রধান কারন ডিপ্রেশন জনিত আত্মহত্যা। ডিপ্রেশন বেশি দেখা যায় মধ্য ও নি¤œ আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশের শতকরা ১৮ থেকে ২০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনো প্রকারের ডিপ্রেশন বা এনজাইটিতে ভুগছেন। পরিবারের অনেকে হয়তো জানেন-ই না যে, তারা ডিপ্রেশনের রোগী। আমাদের অনেকেই আছেন ডিপ্রেশন সম্পর্কে অজ্ঞ এবং কেউ কেউ ডিপ্রেশন রোগই মনে করেন না।
ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদকে রোগ মনে না করা কিংবা পরিবারে কেউ আক্রান্ত সেটা না জানার মতো বিষয়গুলো আসে পরিবারের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক কি রকম তার উপর! আমাদের দেশে সন্তানদের সাথে বাবা-মার দূরত্ব থাকে খুব ছোট থেকেই। যত বড় হতে থাকে সন্তানের সাথে ততই বাড়তে থাকে দূরত্বের পরিমান। এতে সন্তানের খারাপ সময়ে তাকে ভরসা দেয়ার মত অবস্থায় থাকেন না বাবা-মা। এছাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দীতে হওয়া শিল্প বিপ্লবের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে ভেঙে একক পরিবারে রূপ নেয়। ফলে, অধিকাংশ ছেলে-মেয়েরা দীর্ঘসময় ধরে বদ্ধ কামড়ায় আটকে থাকে। তারা ঘুরতে পারে না, তাদের বাবা-মায়েদের লালন-পালন যেভাবে হয়েছে কিংবা যে পরিবেশে হয়েছে সে পরিবেশ পায় না। উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে তাদের শারীরিক ও মাসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হয়। একক পরিবার হয়ে যাওয়ায় বাবা-মা দুজনেই অনেক ক্ষেত্রে কাজে বের হয়। ফলে, সন্তান নিঃসঙ্গ অবস্থায় বেড়ে ওঠে। তার সমস্যার কথা তাদের আর বলা হয় না! হয়তো সন্তানটি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে কিন্তু দুরত্ব ও একাকী বড় হওয়ার দরুন সে আর বাবা-মায়ের কাছাকাছি ঘেঁষতে সাহস পায় না। একদিন মনের বিরুদ্ধেই মনকে শান্ত করতে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিশ্চিন্তে থামিয়ে দেয়।
বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ পুরুষ ও নারী আত্মহত্যা করে, যা যেকোনো যুদ্ধে নিহতের চেয়েও অনেক বেশি। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন নারী বা পুরুষ আত্মহত্যা করছেন। মানুষের এই আত্মহত্যার পিছনে অনেক কারণ থাকলেও বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া আত্মহত্যাগুলো ঘেঁটে দেখলে দেখা যাবে মানসিক অবসাদগ্রস্ততা ও প্রেমজনিত ব্যাপার সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। অনেক ক্ষেত্রে পরকীয়া ও অন্যান্য কারণও জড়িত থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো আত্মহত্যার ঘটনা সামনে এসেছে তার মধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি।
গত এক দশকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনের ইতি টেনেছেন। মানসিক বিপর্যয় সইতে না পেরে সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট এ মিছিলে যোগ দেন বাংলা বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী তোরাবি বিনতে হক। এছাড়াও বিভিন্ন সময় প্রেমজনিত সম্পর্কের টানাপোড়েন, পারিবারিক কলহ, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, একাকিত্ব, চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তায় নানা বিষন্নতার কারণে আত্মহননের মতো পথ বেছে নিয়েছেন আরও ৯ শিক্ষার্থী। শুধু শাবিপ্রবি নয় বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বড় আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ইমাম হোসেন আত্মহত্যা করেছেন। এরকম আত্মহনন শহরের মোড়ে মোড়ে ঘটে যায় কিন্তু মৃত্যুর পরও লাশের সংখ্যা গুনতে থাকা মানুষের মাঝে আত্মার দুঃখ দেখার মানুষ কই!
মৃত্যুর পর অনেকেই বলে থাকে সে ভীরু, এই জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছে তাই মরেছে; আবার অনেকে বলে, আত্মহত্যা মহাপাপ কিংবা আত্মহত্যা সমাধান নয়। এই কথাগুলো একজন মানসিক অবসাদগ্রস্ত রোগী কখনো বুঝবে না। সে বেঁচে থাকার সময় মানুষ পায়নি কথা বলার, তার দুঃখগুলো ভাগ করে নেয়ার তাই তাকে আত্মহত্যার দিকে যেতে হলো! আমাদের সবার উচিত আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোর খোঁজ নেয়া। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডুবে থাকল নিজের বন্ধুকে মৃত্যু কূপ থেকে টেনে তোলাই দেখতে হবে! তরুণরা আগামীর ভবিষ্যৎ। তাদের কন্ঠ শত অন্যায়ের প্রতিবাদ। আজ তারাই যদি তাদের শ্বাস রোধ করে মরে যেতে চায় তাহলে আগামীর বাংলাদেশের কি হবে। সরকারকে এই বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া উচিত। গবেষণা করা উচিত কেন তারা মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছে, কেন হতাশায় ভুগছে। এবং এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার উপায় কি? পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মনোবিজ্ঞানীর কাছে যাওয়ার রীতি থাকলেও আমাদের দেশে এর রীতি নেই। তাই, অনেকে জীবনের ইতি টানে চুপিসারে। আমাদের সবার এ বিষয়ে কথা বলা উচিত আগ্রহ সহকারে যতটা আগ্রহ নিয়ে একজন আত্মহত্যাকারী মৃত্যুর আগে বলতে চায়!

-শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।



   শেয়ার করুন
   আপনার মতামত দিন
     সম্পাদকীয়
প্রতারকদের প্রশ্রয় নয়
.............................................................................................
আত্মহত্যা ও বিবিধ আলোচনা
.............................................................................................

|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
    2015 @ All Right Reserved By dailyswadhinbangla.com

Developed By: Dynamic Solution IT