কোভিড-১৯ (করোনা) প্রাণঘাতী এ ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রায় সব দেশেরই মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এটির ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি আজ ধসের মুখে। প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। থমকে গেছে উৎপাদন। বেকার হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। অর্থনীতির এ সংকট; অতীতের সব মহামন্দাকেই ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কঠিনতম পরিস্থিতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিও। করোনার কারণে বিশ্ব বাজারে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। ইউরোপ- আমেরিকার মতো বড় বড় দেশগুলোতে করোনা মহামারি রূপ ধারণ করায়, অচল হয়ে পড়েছে বিশ্ব বাণিজ্য। এতে পোশাক ক্রেতারা একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল করছে। নতুন আদেশও আসছে না। ফলে দেশের পোশাক শিল্পসমূহ পড়েছে মহাসংকটে। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, কভিড-১৯ সংকটের পর গত এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজারের বেশি পোশাক কারখানার প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্ডার বাতিল বা স্থগিত করেছেন ক্রেতারা, যার বেশিরভাগই ইউরোপ ও আমেরিকায় রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। কিন্তু এ খাতেও ধস নামতে শুরু করেছে। করোনার প্রভাবে ইতিমধ্যে ৭ লাখ প্রবাসী দেশে ফিরেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে - কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী কাজ হারিয়ে দেশে ফিরতে পারে।
বুঝাই যাচ্ছে, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কৃষিই হতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে এটি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। এদেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। শুধু মানুষ নয়, সমস্ত গবাদিপশুর খাদ্য আসে এটি থেকে। বৃহত্তর শিল্পগুলোও এটির উপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ এবং ফসলের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য জ্ঞানের ব্যবহারকে বলা হয় কৃষি। জীবন জীবিকার জন্য এদেশের জনগণ ও অর্থনীতি মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। ২০১৮ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, এটি মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ যোগান দিয়ে থাকে। খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে কৃষির অবদান অপরিহার্য।
প্রাচীন কাল থেকেই কৃষি বাঙ্গালির জীবিকার উৎস। এদেশের মাটি এমনই উর্বর ছিল যে, কোন প্রকার একটু খুঁচিয়ে বীজ বুনে দিলেই তা সোনালী শস্যে রূপ নিতো। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ- এ বিশেষণগুলো আজও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে টিকে আছে।প্রাচীন, মধ্যযুগ ও ব্রিটিশ আমলেও কৃষি অর্থনীতির সর্বাধিক গুরুত্ব লক্ষণীয়। সেন রাজত্বে বিশেষভাবে বিভিন্ন লিপিতে ধানক্ষেতের বিস্তর বর্ণনা পাওয়া যায়। লক্ষ্মণ সেনের অনুলিয়া তাম্রশাসনে হেমন্তে শালিধান কাটার উল্লেখ রয়েছে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে বাংলায় আগমনকারী চীনা পর্যটক হিউয়েন-সাং পুণ্ড্রবর্ধনে পর্যাপ্ত কাঁঠালের কথা উল্লেখ করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে বাংলার জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। বাংলার সুদৃশ্য শ্যামল সবুজ প্রান্তর, পল্লীর ছায়াসুনিবিড় সবুজের সমারোহ তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে, তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা পনের দিন নদীর দুপাশে সবুজ গ্রাম ও ফলফলাদির বাগানের মধ্য দিয়ে নৌকায় পাল তুলে চলেছি, মনে হয়েছে যেন আমরা কোনো পণ্যসমৃদ্ধ বাজারের মধ্য দিয়ে চলছি। নদীর দুই কূলে জমিতে জলসেচের পানি কল, সুদৃশ্য গ্রাম ও ফলের বাগান, যেমনটি রয়েছে মিশরের নীলনদের দুই তীরে।’
মানুষের প্রথম মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য। এটি ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। তাইতো যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবার আগে খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আমরা মোটামোটি সবাই ঘরবন্দি হয়ে আছি। কৃষক কিন্তু বসে নেই। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তারা মাঠে আছে। করোনায় খুব সচেতন স্বাস্থ্য চিন্তা না করে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের মানুষের জন্য যারা খাদ্য উৎপাদন করছে; দিনশেষে তাদের কথা আর আমাদের মনে থাকে না। কৃষি প্রধান এদেশে যেখানে কৃষিকাজ হবে সম্মানজনক পেশা; আর কৃষক হবে সম্মানিত ব্যক্তি। সেখানে কৃষক আজ অবহেলিত, বঞ্চিত। বেগম রোকেয়া বলেছিলেন- ‘ক্ষেতে ক্ষেতে পুইড়া মরি রে ভাই, পাছায় জোটে না ত্যানা,বৌয়ের পৈছা বিকায় তবু, ছেইলা পায় না দানা!’ গত বছর আমরা দেখেছি, কৃষক তার হারভাঙ্গা পরিশ্রম আর পরম যত্নে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পায়নি। ফলে পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে কৃষকের প্রতিবাদ করার মত বেদনাদায়ক দৃশ্য জাতিকে দেখতে হয়েছিল। মাঠে সোনালী ফসল ফলাতে, অনেক শ্রম ও ঘাম ঝাড়াতে হয় তাদের। কিন্ত সে দামও যদি তারা সঠিকভাবে না পায়। কি করে বাঁচবে তারা। আর তারা যদি খাদ্যশস্য উৎপাদন না করে; আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে-উচ্চশিক্ষিত মানুষ যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তাহলে মেরুদণ্ড রক্ষাকারী হলো কৃষক।
আশার খবর হলো, সরকার কৃষি ও কৃষককে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখছেন। দেশে করোনাভাইরাসের কারণে খাদ্য সংকট এমনকি দুর্ভিক্ষ ও দেখা দিতে পারে। সংকট থেকে উত্তরণে সরকার বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। তারই প্রেক্ষিতে এবারের বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এ সেক্টরে। কৃষির উন্নয়নে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে - সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে যেন অন্য দেশকেও সহযোগীতা করা যায় সে বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন- এবার বোরোর ফলন ভালো হওয়ায় এবং কৃষকরা ভালো দাম পাওয়ায় আগামী সাত মাস গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা থাকবে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে কৃষিতেই তারা ভরসা খুজছেন।
দেশের অর্থনীতিতে সবসময় যে খাতটি সচল তা হলো কৃষি। করোনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল। তাই এ খাতকে গুরুত্বের সাথে দেখা এখন সময়ের দাবি। কৃষিকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। নতুন নতুন কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবন করে, কৃষকের দোরগোড়ায় পৌছে দিতে হবে। তারা যাতে তা থেকে সুফল পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করতে পারলে তারা দেশের অর্থনীতিতে আরো সুফল বয়ে আনতে পারবেন। করোনাকালীন এ সময়ে হাওরে কৃষক ধান কাটার জন্য শ্রমিক না পাওয়ায় চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পরেন। এ অবস্থাতে কম্বাইন্ড হারভেস্ট মেশিন তাদের চিন্তামুক্ত করেছিল। এ যন্ত্রটি দিয়ে ধান কাটা ও মাড়াই উভয় কাজ করা যায়। বিশ্ব যখন প্রযুক্তির আর্শিবাদে দিনদিন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। কৃষকদের সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধিতে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগীতা করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কৃষি বিশেষজ্ঞগণ তাদের সাথে কথা বলতে পারেন, এবং কৃষিক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে অবহিত করতে পারেন। সর্বোপরি তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিতে পারেন। পরিশেষে বলতে চাই- ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষিই আমাদের এগিয়ে নিতে সক্ষম। তাই কৃষি ও কৃষককে যথাযথ মূল্যায়ন করা অপরিহার্য । কৃষক বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে।