শিরোনামটি বাংলাদেশের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী ও বাংলা সঙ্গীতের যুবরাজখ্যাত আসিফ আকবরের গান থেকে নেয়া। এটি গানের কথা হলেও এই বাক্যটির তাৎপর্য অনেক বেশি। বাংলাদেশে আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে কমবেশ সকলেই যে হাওয়াই মিঠাই। যারা মুখোশের আড়ালে সব অপকর্ম করে, স্বার্থ হাসিলের জন্য হেন কোন কাজ নেই যা করে না, তারা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মানুষ খুনও করতে পারে, প্রতারণা, জালিয়াতি, মিথ্যার আশ্রয়, দূর্নীতি, অনিয়ম, গুম সহ সকল অপরাধজনক কর্মকান্ড করে বেড়ায়। লোক ঠকানোর অভ্যাস তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু সমাজের চোখে তারা সাধু, বুদ্ধিজীবি, দানবীর, নীতিবান, সম্মানিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাদেরকে মাকাল ফলের সাথেও তুলনা করা যায়, তাদের বাহিরটা দেখতে সুন্দর, ভেতরটা কুৎসিত। শুধু সম্পদ বা ক্ষমতার জন্যই নয়, আমরা ছোট বড় সকল স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই আমরা মুখোশের আড়ালে কূটকৌশলের আশ্রয় নেই।
বাংলাদেশে প্রতারণার মাধ্যমে লোক ঠকিয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া এতো সহজ কিভাবে? এই প্রশ্ন উঠলে উত্তর আসে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো নয় এবং বিচার ব্যবস্থা পক্ষপাত দুষ্ট। পাশাপাশি তোষামোদ শিল্পের পর্যায়ে চলে আসায় ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদ ও দলের ছত্রছায়ায় থেকে তোষামোদি করে চললেই স্বার্থ উদ্ধার করা সহজ হয়ে যায়। এসএসসি ও এইচএসসি পাশ ব্যক্তি হয়ে যায় দেশ বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের সুনজরে থাকতে পারলেই ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা, ধরাকে সরাজ্ঞান করা যায় সহজে, যা মন চায় তা করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এই সকল মুখোশধারী প্রতারকেরা এতোই দূরন্ধর ও অমানবিক যে, করোনা মহামারির মতো মানবিক বিপর্যয়ের সময়েও তাদের প্রতারনা বন্ধ রাখতে পারেনি, অর্থ লিপ্সায় উম্মাদ হয়ে ভূয়া সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে দেশের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। করোনা ভাইরাসের মতো একটি ছোঁয়াচে রোগের নমূনা সংগ্রহ করলেও পরীক্ষা না করে পজেটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে স্বাস্থ্যজনিত হুমকিতে ফেলেছে গোটা দেশকে। সেই সাথে অনেকেই লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালনা করছে হাসপাতাল। রাজনৈতিক পরিচয় ও বড় বড় নেতাদের সাথে তোলা ছবিকে পুঁজি করে অবৈধ ব্যবসা খোলে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। নিঃশ্ব হচ্ছে বহু পরিবার। ভুক্তভোগীরা মামলা করলেও এসব মামলা আলোর মুখ দেখে না, ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে থাকে।
বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ হয়েছে বাংলাদেশে, সেসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকলেও তাদের ভেতরটা মাকাল ফলের মতো। মুখোশের আড়ালে এরা মাদক ব্যবসা, সুন্দরী নারীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা, ক্যাসিনো/জুয়ার ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষা বানিজ্য, লবিংয়ের মাধ্যমে অসাধু কাজ করা সহ এমন কোন প্রতারনা ও অপরাধজনক কাজ নেই যে তারা করে না, যার মাধ্যমে দেশ ও জাতির অপূরনীয় ক্ষতিসাধিত হচ্ছে। বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
প্রতারকেরা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, ক্ষমতাসীন দলের কোন নেতা কিংবা সরকারের উচ্চ পদস্থ কোন কর্মকর্তার আস্থা অর্জন করতে পারলেই এরা অবৈধ সব কাজে জড়িয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে। এদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও বিচার হয় না, মামলার কথা প্রকাশ্যে আসে না, বাদীকে খুন গুমের ভয় দেখিয়ে ধমিয়ে রাখে, ফলে বিচার না হওয়ার কারনে এদের অপকর্ম আড়ালে থাকে। এই ধরনের অপরাধীদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতির মাঠে সরব থাকার পাশাপাশি মিডিয়াতেও বুদ্ধিজীবির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, নিজেদের অপকর্মের বিপরীতে দেশপ্রেমিক সাজে। তাদের দেখে বুঝা যায় না, তাদের আসল চরিত্র।
দুঃখজনক বিষয় এই যে, ভদ্রলোকের বেশ ধরে থাকা অপরাধীদের বড় কেলেঙ্কারি প্রকাশের আগে বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে দেশের বিভিন্ন থানায় তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও সেসব মামলায় বিচার না হওয়ায় তারা প্রতারনার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়, নিজেদেরকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অংশ মনে করে। তাদের কাজে কেউ বাঁধা হয়ে দাড়াতে চাইলে গুম করা সহ নিজেদের অবৈধ টর্চার সেলের মাধ্যমে অমানবিক নির্যাতন করে। মিডিয়ার মাধ্যমে এমন খবরও প্রকাশিত হচ্ছে অহরহ। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকাই এর বড় কারণ হিসেবে মনে করছে সচেতন নাগরিক সমাজ।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ, বর্তমান সরকারের অধীনে দেশ এগিয়ে গেলেও দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারী এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা পেশাদার অপরাধীদের অপকর্মের কারনে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে দেশ বিদেশে, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের মানুষ, নষ্ট হচ্ছে যুব সমাজ, অপরাধ বাড়ছে দিনদিন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। চাকুরী ক্ষেত্রে যোগ্যরা মূল্য পাচ্ছে না, অযোগ্যরা সব দলখ করে বসে আছে। গ্রাম থেকে শহর, তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় রাজনীতি, সর্বত্রই অপরাধী ও প্রতারকেরা সুবিধা হাসিলের জন্য উৎপেতে থাকে। এ ধরনের মুখোশধারী প্রতারকদের চিরুনি অভিযান চালিয়ে ধৃত করে আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি প্রদানের কোন বিকল্প নেই। একটি দেশকে এগিয়ে নিতে দুর্নীতি মুক্ত করতেই হয়, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশ ও জাতি কখনোই এগিয়ে যেতে পারে না। বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করা ও দেশকে এগিয়ে নিতে হলে হাওয়াই মিঠাই ও মাকাল ফল বেশধারী অপরাধীদের শক্ত হাতে ধমন করতেই হবে।
শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া(বিজেম)।