রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিভাগের একটি হলো বিচার বিভাগ। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট থেকে শুরু করে জেলা আদালতগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মামলার বিচার কাজসহ মানবাধিকার ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনস্বার্থে ভূমিকা পালন করে আসছে আদালতের বিচারক, আইনজীবীসহ আদালত সংশ্লিষ্টরা। প্রতিদিন লাখ লাখ বিচার প্রার্থী দেশের আদালতগুলোতে ভীড় করে থাকে। বিগত ২৬ মার্চ থেকে চলমান করোনা মহামারীর ছুটি ও লকডাউনে নিয়মিত আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও গত ৯ মে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারিকৃত তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০ এর মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থা সচল রাখতে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসাবে আমাদের বৃটিশ আমলের সনাতনী কোর্ট পদ্ধতিতে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হয়। উক্ত অধ্যাদেশের ৫ ধারার ক্ষমতাবলে গত ১০ মে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে আদালতে শারীরিক উপস্থিতি ছাড়া শুধু জামিন শুনানীর জন্য উচ্চ আদালতসহ অধস্তন আদালতের জন্য বিশেষ প্যাকটিস নির্দেশনা জারি করেন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত ১১ মে থেকে ২৫ জুন, ২০২০ ইং পর্যন্ত ৩০ কার্য দিবসে সারা দেশের অধস্তন আদালতে ভার্চুয়াল শুনানীতে মোট ৮৪ হাজার ৬৫৭ টি জামিন আবেদন নিষ্পত্তি করে মোট ৪৪ হাজার ৮০২ জন আসামীকে জামিন দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে করোনা কালীন সময়ে আদালতের এই কার্যক্রম বিচারপ্রার্থীদের কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু এই কার্যক্রমের বিষয়ে আরো বিশদ চিন্তা ভাবনা এবং সিদ্ধান্তের অবকাশ রযেছে। এই পদ্ধতিতে কাজ করতে গিয়ে প্রতারণা করে জামিন প্রাপ্তিসহ নানা বিষয়ে বিচারকগণ যেমন সমস্যায় পড়েছেন, তেমনি আইনজীবীগণও ইনটারনেটের কম গতি, শুনানীর সময় সংযোগ বিছিন্ন হয়ে যাওয়া, স্ক্যানার ব্যবহার করা, তদবীর করে মামলা লিস্টে এনে শুনানী করে জামিন পাবার পর সেই মামলা লিস্ট আউট দেখানোসহ বহু জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। এছাড়াও মামলা পরিচালনা করার জন্য ওকালতনামা, বেইলবন্ড, রিলিজ ইত্যাদি ক্রয় করতে আইনজীবীদের সশরীরে কোর্টে যেতেই হচ্ছে। তাছাড়াও যাদের ক্রিমিনাল/জামিনের প্যাকটিস তেমন নেই তারা এই ভার্চুয়াল কোর্ট পদ্ধতিতে হতাশা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
করোনা পরিস্থিতি আর কতদিন বিদ্যমান থাকবে সেটা হলফ করে বলা অসম্ভব। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের মানুষের জীবন জীবিকায় এর মারাত্মক প্রভাব লক্ষণীয়। ব্যবসা- বানিজ্য মন্দা, কল কারখানায় উৎপাদন সীমিত, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে বিদেশী ক্রেতাদের আনাগোনা নেই, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত, দিনমজুর, শ্রমজীবী মানুষেরা বেকার। করোনার প্রাদুর্ভাব জীবনের স্বাভাবিক গতিকেই থামায় নি বরং মানুষকে সেই আদিম লড়াই অর্থাৎ বেচেঁ থাকার বা টিকে থাকার লড়াইয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। করোনার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি দেশের আদালত পাড়া। বিচার কার্যের দীর্ঘসূত্রিতা, বিচার প্রার্থীদের হাহাকার, আইনজীবীদের জীবন জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। আইনের সেবা আইনজীবীদের পেশা হলেও এই পেশায় সাধারণ আইনজীবীগণ সরকার কর্তৃক কোন বেতন বা ভাতা পান না। বাংলাদেশে প্রায় ৬০ হাজার আইনজীবী রয়েছেন তার মধ্যে প্রায় ১০ হাজার আইনজীবী আছেন সুপ্রীম কোর্টে। সব মিলিয়ে ৫ হাজার আইনজীবী সিনিয়র ও সরকারী পদের সুযোগ-সুবিধা পেলেও বাকী সবাই দিনে আনি দিনে খায় অবস্থায় জীবন যাপন করেন। জীবিকা বন্ধ থাকলেও জীবন থেমে নেই কারো। থেমে নেই হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আত্মসাৎসহ অন্যান্য অপরাধও। আমরা জানি Justice delayed is justice denied. বর্তমান ভার্চুয়াল কোর্টে কেবল মাত্র হাজতী আসামীর জামিন আবেদন ছাড়া অন্য কোন আবেদন শুনানীর সুযোগ নেই। তদন্তের প্রয়োজনে রিমান্ড কিংবা শ্যোন এরেস্টের আবেদন কিংবা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পনের জামিন আবেদন কোনটাই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অভিযুক্ত যেমন প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জামিন ও ন্যায় বিচার লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আদালত সংশ্লিষ্ট সকলের জীবিকা।
সারাদেশে ইতোমধ্যে সাধারণ ছুটির মেয়াদ শেষে সব সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেটগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। আইনজীবীদের মাঝেও স্বাভাবিক কর্ম তৎপরতা শুরু হয়েছে। এমতাবস্থায় দেশের আদালতগুলোর প্রবেশ পথে থার্মাল স্ক্যানার, জীবাণুনাশক বুথ ও পর্যাপ্ত হ্যান্ড সেনিটাইজারের ব্যবস্থা করে অ্যাকচুয়াল আদালত চালু করার জন্য আইনজীবীদের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা হয়েছে। আইনজীবীদের অভিভাবক বাংলাদেশ বার কাউন্সিলও দেশের সকল বার ও আদালতে স্বাস্থ্যবিধি মান্য বিষয়ক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে প্রধান বিচারপতি ও বার এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিচারপতিদের জন্য সীমিত পরিসরে নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আইনজীবী ও আদালত সংশ্লিষ্টদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন করোনা টেস্ট বুথ স্থাপন করা কয়েছে। এছাড়াও আইনজীবীদের চিকিৎসা সেবার জন্য কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। তাই সবশেষে বলব করোনা ভয়ে ঘরে না লুকিয়ে আসুন সচেতন থেকে সাস্থ্যবিধি মেনে সহজ কিছু অভ্যাস তৈরী করি। অ্যাকচুয়াল আদালত এখন সময়ের দাবী।
তামান্না আফরিন অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।