কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃক্ষের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলেছেন, - ‘আমরা যেমন স্নান করি এবং শুভ্র বস্ত্র পরিধান করি, তেমনি বাড়ির চারপাশে যত্ন পূর্বক একটি বাগান করে রাখা ভদ্র প্রথার একটি অবশ্য কর্তব্য অঙ্গ হওয়া উচিত।’ পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদানকে আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান, ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার (সূত্র: ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট, ভলিউম-১১, সংখ্যা ১-২)
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী জীবনাদর্শনের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন সজীব বৃক্ষকে। কারণ মানবজীবনের আদর্শ হিসেবে বৃক্ষের মত জীবন্ত উপমা আর নেই। এটির কাজ শুধু মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলা নয়, এটিকে ফুল ফোটাতে হয়, ফুল ধরাতে হয়। তিনি আরও বলেছেন- বৃক্ষের ন্যায় মানুষকেও জগতের কল্যাণে নীরব ধূপের মত নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার সাধনা করতে হবে।
আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য গাছগাছালির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এটি সমগ্র প্রাণীকুলের খাদ্যের যোগান দেয় এবং সুবিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে উত্তপ্ত ধরণীকে শীতল রাখে। গাছপালা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে আমাদের উপকার করে তা নয়। বড় বৃক্ষ বজ্রপাত প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। যেখানে বড় গাছপালা থাকে, সেখানে নদী ভাঙ্গনের হারও কমে যায়। এছাড়াও বৃক্ষরাজি বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি প্রতিরোধ করে, জীববৈচিত্র টিকিয়ে রাখে। গাছ আমাদের পরম বন্ধু। এটি মানুষের খাদ্য, ঔষধ, গৃহ নির্মাণ, মাটির ক্ষয় প্রতিরোধ, জ্বালানি, আবহাওয়া ও জলবায়ু সঠিক রাখা, কৃষি জমির উৎপাদন বৃদ্ধি করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লেখার কাগজ, কর্ক, রবারসহ রাশি রাশি জিনিসপত্র আমরা বৃক্ষ থেকে পেয়ে থাকি।
আমাদের দেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য- শ্যামলা বলা হলেও বৃক্ষের প্রতি আমাদের রয়েছে চরম অনীহা। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য ও সুষম জলবায়ুর প্রয়োজনে একটি দেশের মোট আয়াতনের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা আবশ্যক। ডব্লিউআরআই এবং জিএফওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১০ সালে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ হেক্টর, যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ অবস্থার আশু পরিবর্তণ আবশ্যক। বৃক্ষ নিধন, বন উজাড়, পরিবেশের বিপর্যয়ের জন্য আজকাল বজ্রপাতে লোক মারা যাচ্ছে। মানুষের জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে ধ্বংশ হচ্ছে বনভুমি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট হচ্ছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে অনেক পরিবার বাড়িঘর হারিয়ে হচ্ছে সর্বহারা।
মানুষ না থাকলে গাছের কোন অসুবিধা হতো না, কিন্তু বৃক্ষরাজি না থাকলে মানুষের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত।বৃক্ষের প্রয়োজনে নয়, আমাদের প্রয়োজনেই গাছ লাগাতে হবে। বাড়ির পাশে, রাস্তাঘাট, পরিত্যক্ত জায়গা, নদীর পারে, রেললাইনের দুইপাশে, বাঁধের ধারে, উপকূলীয় অঞ্চলে আমরা বৃক্ষ রোপন করতে পারি। শহর অঞ্চলের বাসাবাড়ির ছাদগুলোকে যদি একটু সবুজ করা যায়,তাহলে শহরের তাপমাত্রা কমে যাবে। ছাদের বাগান বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে ঘরের তাপমাত্রা প্রায় ১.৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমাতে পারে এমনটাই বলছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।
পরিবেশ বা বৃক্ষ রোপন নিয়ে আমাদের উদ্যোগ ক্লাসরুম, সেমিনার, সভা-সমিতির মধ্যে সীমিত থাকলে চলবে না, প্রয়োজন তার বাস্তব প্রতিফলন। পরিবেশ রক্ষায় গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। করোনার এ সময়ে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এটা তাদের জন্য আরো উপযুক্ত সময় বলে আমি মনে করি। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস পৃথিবীর প্রায় দেশে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই বাড়ির কোণ বা ছাদে ফলমূল, শাক-সবজি গাছ লাগিয়ে; পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে দেশের অর্থনীতিতেও আমরা অবদান রাখতে পারি।
- মোঃ মারুফ হোসেন শিক্ষার্থী, ধর্মতত্ত্ব অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়া।
|