আচ্ছা, হ্যান্ড ওয়াশ হবে? করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বার বার হাত ধুতে হয়। তাই নাজিম উদ্দিন হ্যান্ডওয়াশের খোঁজে এলেন। হবে। দোকানদার হারু বললো। কতো টাকা? ৭০ টাকা। গায়ের রেট ৩৫ টাকা। ৭০ টাকা চাচ্ছেন কেন ? এখন দেশের যে অবস্থা হ্যান্ডওয়াশ বাজারে নাই। আমরা অনেক খুঁইজা কয়টা আনলাম। তাও বেশি দাম দিয়া আনতে হইলো। অ। তাহলে একটা সাবান দিন। শুনে হারুর মুখ কালো হয়ে গেলো। সাবান ক্যান? হ্যান্ডওয়াশ নেন। হ্যান্ডওয়াশে ভালো কইরা হাত পরিষ্কার করা যায়। না থাক। নাজিম উদ্দিন সাহেব পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে টাকা দেখলেন। টাকা নাই? ঠিক আছে তাইলে সাবানই নেন। হারু বললো। বল্টু পাশে বসে দেখছিলো।
নাজিমুদ্দিন একটা সাবান নিলেন। তাকে খুব রুক্ষ এবং চিন্তিত লাগছিলো। শীর্ণ দেহে মাথা নিচু কি ভাবতে ভাবতে যেন বাসার দিকে গেলো। প্রায় সময় তিনি দোকানে এসে চাল-ডাল দেখেন। যে চালের সবচয়ে কম দাম মুখ কালো করে তাই নেন। এক লিটার তেল না নিয়ে হাফ লিটার নেন। বেশিরভাগ সময় আলু কেনেন। তাও পরিমাণে খুব বেশি না। পেঁয়াজ-রসুনের মত বিলাসী জিনিস কেনা ছেড়ে দিয়েছেন।
বল্টু নাজিম উদ্দিনকে চিনে। এ পাড়ায় বাসা। আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সংসারে অনেকগুলো মুখ। করোনা ভাইরাসের প্রকোপের পর থেকে তার অবস্থা আরো শোচনীয়। আগের চেয়ে সবকিছু কম করে নিচ্ছেন। বাকিতে চাইলেও হারু দেয় না
ঐসব বাকিটাকি হবে না। হারু মুখের উপর বলে দেয়।
চাছা, করোনা খুব ভয়ংকর অসুখ? বল্টু হারুকে বললো। হরে বল্টু, তাইতো হুনতাসি। কয়নাকি ঔষধ নাই। একবার অসুখটা অইলে মইরা যায়। হ। আল্লাহ যদি বাঁচায় তো বাঁচার আশা আছে। নইলে আর কোনো আশা নাইরে। তাইলে সব আল্লাহর উপর ছাইরা দাওনা ক্যান? কি কইতে চাস? হারু ব্রু কুঁচকালো। কইতে ছাই আফনে দোকানে অনেক চাল, ডাল, হ্যান্ডওয়াশ আরো অনেক কিছু আইনা রাখসেন। কিন্তু নাই বইলা বেশি দামে বেচেন। অনেক মানুষ দাম বেশি শুইনা নিতে পারতেসেনা। এইডা কি ঠিক? হারু চার পাশে তাকিয়ে দেখলেন কেউ আছে কিনা। এই তুই বেশি কতা কস। বেশি না। ভাইবা দেহ ঠিক কইতাসি। এহন যা অবস্থা তোমারেও যদি অসুখটা দরে। কি করবা? কি আজে-বাজে কস? হারুন একটু ভয় পেল। ঠিক কইসি। আমারেও মনে অয় অসুখটা দরছে। দুদিন থেইকা দেহি গলা বেথা.. জ্বর জ্বর লাগতাসে। বল্টু খুক খুক করে কাশল।
হারুরও দুদিন থেকে জ্বর জ্বর লাগছে। এখন তার মনে হচ্ছে বল্টুর সাথে থেকে তার জ্বর আসলো। আগের ছেয়ে গলাটা বেশি ব্যাথা লাগছে। শুকনো কাশিও আছে। হারু খুক খুক করে কাশলো।
হারামজাদা তোরে আজকে ...হারুন বল্টুকে মারতে উঠলো।
আমারে মাইরা লাভ নাই। রোগটা আল্লাহ দিসে, তাই তার কাছে মাফ চাও। আর মরার আগে না খাইতে পাওয়া মানুষগোরে কম মূল্যে সব বেইচা দাও। আল্লাহ খুশি অইবো।
দুর্বল চিত্তের মানুষ মরণকে খুব বেশি ভয় পায়।। মরণকে ভয় পায়না দেবতুল্য মানুষ এবং মানুষ রুপি শয়তান। হারুন দুর্বল চিত্তের। তাই সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে সে কম মূল্যে বিক্রি করছে।
বল্টু নিজ মনে হাসতে লাগলো। সে হারুনকে মিথ্যে ভয় দেখিয়েছে। তবে তার এখন হারুর দোকানে জায়গা হয়না। রাস্তার পাশেই থাকতে হয়। তবুও তার খুশির সীমা নেই। কারণ আজকে নাজিম উদ্দিনের মতো অনেকেই হারুর দোকান থেকে কম মূল্যেই সব বাজার করতে পারছে।
নাজিমুদ্দিনকে দেখলে বল্টুর নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যায়। সে যখন বাবার সাথে দোকানে যেত, তার বাবাও জিনিসপত্রের দাম দেখে বার বার নিজের পকেটে হাত দিয়ে টাকা চেক করে দেখতো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে না পারলে বাড়ি ফিরত মন খারাপ করে। অনেকদিন আগে রিক্সা চালানোর সময় তার বাবা রোডএকসিডেন্টে মারা যায়। নিজের পরিবারের দায়িত্ব নিতে সেই থেকে বল্টু এই দোকানে কাজ করে। কিন্তু হারুকে তার মোটেই পছন্দ না। লোকটার মধ্যে মানবিকতার লেশমাত্র নেই। বল্টু পার্কের বেঞ্চে শুয়ে আকাশের দিকে তাকালো। তার মা বলে তার বাবা নাকি আসমানবাসী হয়ে গেসে।
বাবা তোমারে খুব মনে পরে। বল্টুর দু চোখ গড়িয়ে পানি পড়লো।