শনিবার, ২০ এপ্রিল 2024 বাংলার জন্য ক্লিক করুন
  
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|

   উপসম্পাদকীয়
  কৃষিই বাঁচাতে পারে বাংলাদেশকে
  1, May, 2020, 4:37:43:PM

ড. মীজানুর রহমান


ড. মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ ১৯৬০ এর দশকে আদমজী জুট মিলের শ্রমিকদের পুনঃপুনঃ  অনুপস্থিতির কারণ  গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন বাংলাদেশে কেবলই পাটকল শ্রমিক বলতে কেউ নেই। শ্রমিকদের প্রত্যেকেরই গ্রামে  বাড়িঘর আছে, অল্প হলেও কৃষিকাজ আছে এবং প্রত্যেকেই কৃষিকাজের সাথে জড়িত। ফসল বুনতে অথবা ফসল তুলতে তারা বছরে চার থেকে ছয়বার বাড়িতে যায়। কার্ল মার্কস এর `সর্বহারা` অর্থাৎ যার শ্রম ছাড়া বিক্রি করার আর কিছু নেই, এমন শ্রমিক তখন প্রায় ছিল না বললেই চলে। তাই কৃষি শ্রমিক আর শিল্প শ্রমিক বলতে আলাদা করে কেউ ছিল না। মহিলারা শিল্প শ্রমিক হতে পারে এমন কথা এদেশে তখন ভাবাই হত না। স্বাধীনতাত্তোর কালে সবকিছু বদলাতে শুরু করলো। এখন আমাদের ফরম্যাল সেক্টরের একটি বিরাট অংশ মহিলা। কেবল পোশাক শিল্পেই এদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ। ১৯৬০ সালে যেদেশের শতকরা মাত্র ৫.১৪ ভাগ লোক শহরে বাস করতো, ২০১৮ সালের হিসেবে এ সংখ্যা এখন ৩৬.৬৩%। ২০০৮ সালেও এটা ছিল ২৮.৯৭%। ১৯৯৫-৯৬ সালে মোট শ্রম শক্তির ১১% শিল্পে এবং ২৬% সেবাখাতে জড়িত ছিল। কৃষিতে ছিল ৬৩%। ২০১৫-১৬ সালে শ্রমশক্তির ৩৯.৭১% ছিল কৃষিতে ২০০৮ এ এই হার ছিল ৪৭.৫২%। সুতরাং আমাদের কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। একদিকে আমাদের কৃষির উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে কৃৃষিতে কর্মসংস্থান কমছে। কৃষির যান্ত্রীকিকরণের কারণে কম কর্মসংস্থান নিয়েও বেশি খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। যান্ত্রীকিকরণ ও আধুনিক চাষ পদ্ধতি, উফশী ( উচ্চ ফলনশীল) বীজ, সার, সেচ ও কীটনাশক ব্যবহারের মত খাতে বেশি বিনিয়োগ করেই আমরা বেশি ফলন পাচ্ছি।

এদেশের কৃষকের শত বছরের পুরনো সমস্যা ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির সমস্যা। একদিকে কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য অন্যদিকে উৎপাদিত পন্যের নিম্নদাম আমাদের কৃষির লাগাতার সমস্যা (Present perfect continuous tense)। শিল্প ও সেবাখাতের ব্যাপক প্রসারের কারণে কৃষিখাতে শ্রমিকের বড় সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিবারই ফসল কাটা ও বপনের সময়ে তীব্র শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। দৈনিক ৮০০/১০০০ টাকা মজুরি দিয়েও একজন শ্রমিক পাওয়া যায় না। কিছু কিছু অঞ্চলে গ্রামের প্রায় সব শ্রমিকই শহরে চলে এসেছে রিকশা চালাতে বা গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করতে। শহরে গৃহস্থালী কাজের একজন সহায়ক পাওয়ার চেয়ে গ্রামে পাওয়া আরোও দুষ্কর। আমার মাকে গ্রাম থেকে একজন কাজের লোক যোগাড় করে দিতে বললে মা বলেছিলেন, পারলে ঢাকা থেকে আমার জন্য কাজের লোক পাঠাও।

শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দুটি তত্ত্ব হচ্ছে ধাক্কা তত্ত্ব( Push ) আর টানা তত্ত্ব ( Pull )।  প্রচুর লোক প্রতিবছর নদীভাঙন বা অন্যান্য কারণে সর্বস্ব হারিয়ে জীবন জীবিকা নিয়ে চরম ধাক্কা খেয়ে কর্মের খুঁজে সপরিবারে এসে শহরে (বস্তিতে) আশ্রয় নেয়। আবার কিছুলোক শহরে বিশেষ করে ঢাকায় চলে আসে ঢাকার আকর্ষণে। ঢাকা তাদের টানে। ঢাকায় অনেক আলো, বাতি, ফ্লাইওভার, কাজ ও সহজে বিয়ে করার সুযোগ, যা গ্রামে ততটা নেই। তাছাড়া গ্রামের পাট বা আখ খেতের কাজের চেয়ে শহরে রিকশা চালানো অনেক কম পরিশ্রমের। উল্লেখ্য ঢাকায় এখনো প্রচুর পায়ে প্যাডেল দিয়ে চালানো রিক্সা থাকলেও মফস্বল শহরে প্রায় সব রিকশাই ব্যাটারিচালিত। শহরের মানুষের পোশাক, খাবার, বিনোদন যা টিভিতে দেখে তার সবকিছুই কিছু মানুষকে আকর্ষণ করে তাই তারা শহরে চলে আসে যদিও একপর্যায়ে অন্ধকার বস্তির ঘরেই তার ঠাই হয়।

কৃষিতে অতিমাত্রায় যান্ত্রিকীকরণে আমাদের কৃষি উৎপাদন বাড়বে কিন্তু কর্মসংস্থান কমবে। যেমনটি হচ্ছে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। আমাদের প্রবৃদ্ধির সাথে কর্মসংস্থানের মিল নেই। র‍্যাপার মেশিন দিয়ে বা কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ফসল কাটলে বড় কৃষকের খরচ কমে যাবে কিন্তু সাথে সাথে কৃষিতে কর্মসংস্থানও কমে যাবে। ছোট কৃষকরা বড় কৃষকের কাছে মার খাবে। যে কৃষক দৈনিক একহাজার টাকা মজুরীর শ্রমিক দিয়ে ধান কাটলো বা মাড়াই করল সে বড় কৃষকের কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের উৎপাদনশীলতার কাছে মার খাবে। এর একটা সমাধান হতে পারতো কৃষি সমবায়। কিন্তু সমবায়ের অভিজ্ঞতা গত ৭০ বছরে আশানুরূপ নয়। জাতিগতভাবে প্রত্যেকে আমরা নিজের তরে। যা সমবায়ের বড় অন্তরায়।

অতএব কৃষির অতি আধুনিকীকরণের পরিণতি হবে ক্ষুদ্র কৃষকের উচ্ছেদ। বৃহৎ কৃষি খামার ও বাণিজ্যিক উৎপাদন,  ভোক্তার জন্য এ ব্যবস্থা কতটুকু সাশ্রয়ী হবে তা বলা মুশকিল। তখন অল্প সংখ্যক উৎপাদনকারী উৎপাদন ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করলে অবস্থা বর্তমানে যেভাবে চলছে তারচেয়ে ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা আমি দেখছি না।

ইউরোপ-আমেরিকা, যারা আমাদের সেলাই করা পোশাকের ৯০ শতাংশের ক্রেতা, করোনার কারণে সেখানে নতুন পোশাকের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। আমাদের গার্মেন্টসগুলো খুলছে পুরনো অর্ডার অনুযায়ী কাপড়গুলো সেলাই করার জন্য। নতুন অর্ডার না আসলে শত প্রনোদনা দিয়েও আমাদের গার্মেন্টস খোলা রাখা যাবে না। আমি নিশ্চিত, বহু পোষাক কারখানাই বন্ধ হয়ে যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে অনেক পোশাক শ্রমিকেরই গ্রামে ফিরে যেতে হবে। কিছু গার্মেন্টস মালিক ফ্যাক্টরি রেখে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দিয়ে বিলাসী জীবন যাপনের জন্য বিদেশে পালাবে।

দ্বিতীয় আয়ের খাত হচ্ছে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা রেমিট্যান্সে ধ্বস কোন ইনসেন্টিভ দিয়েই থামানো যাবে না। প্রচুর প্রবাসী দেশে ফিরে আসবে। যারা থেকে যাবে তাদের মজুরী ও আয় কমে যাবে। অতএব আমাদের অর্থনীতির দ্বিতীয় পিলারটিও নড়বড়ে হয়ে যাবে।

বাকী থাকলো আমাদের একমাত্র কৃষিখাত। এটাই আমাদের ভরসার জায়গা। কৃষিতে আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁজতে হবে। কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন করলে খরচ হয়ত বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আমরা যারা শহুরে চাকুরী বা পেশাজীবী তাদের বেশিদামে কৃষিপণ্য কেনার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের জীবন যাত্রার মান বেড়ে যাবে এর অর্থ হচ্ছে কৃষিকাজে নিয়োজিত কৃষকের ও শ্রমিকের আয় বেড়ে যাবে। তাদের আয় বাড়লে দেশে উৎপাদিত শিল্প পণ্যের চাহিদা বাড়বে; এতে এখানেও কর্মসংস্থান ও আয় বাড়বে। আরোও দশ বছর আগে বার্লিনের ফুটপাতের একটি গ্রোসারী দোকানে এক কেজি আলু ২ ইউরো আর মিষ্টি আলু ২.৫ ইউরো দেখে এসেছিলাম। রাজনৈতিক কারণে আমরা কৃত্রিমভাবে কৃষিপণ্যের বিশেষ করে চাউলের দাম বাড়তে দেই না। পুরো বিষয়টা বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে। কেবল সরবরাহের বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে যাতে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহে কোন ঘাটতি না থাকে।  প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সরবরাহে ঘাটতির সম্ভাবনা দেখা দিলে পরিকল্পনা মাফিক আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অতি আবশ্যকীয় না হলে আমদানির প্রয়োজন নেই। এক বছর দাম বেড়ে গেলে পরের বছর কৃষকরাই উৎপাদন বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান করে দিবে। শিল্প ও সেবাখাতে সম্ভাব্য মন্দার মোকাবেলায় কৃষিই হবে আমাদের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় জায়গা। পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে পারলে কৃষিই বাঁচাবে বাংলাদেশকে।

লেখকঃ উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।



   শেয়ার করুন
   আপনার মতামত দিন
     উপসম্পাদকীয়
শৃঙ্খলার নিগূঢ় থেকে মুক্তিই প্রত্যাশা
.............................................................................................
প্রসঙ্গ স্বশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত প্রার্থী
.............................................................................................
অপার সম্ভাবনাময় নদীপথকে যেকোন মূল্যে বাঁচাতে হবে
.............................................................................................
বাংলাদেশে রেলপথ বিকাশের ইতিহাস
.............................................................................................
কেন বাংলা টাইপিংয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না
.............................................................................................
আত্মহত্যা উদ্বেগ করণীয়
.............................................................................................
বিপণনের অভাবে ক্ষতির সম্মুখীন কৃষিখাত
.............................................................................................
দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ: তৃণমূল পর্যায়ে সুদের বিস্তৃতি
.............................................................................................
কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিবারের দায়িত্বশীলতা দরকার
.............................................................................................
প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা
.............................................................................................
পুঁজিবাদী পশ্চিমা বিশ্ব বনাম সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার দ্বন্দ্ব
.............................................................................................
১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় জেল হত্যা ও গ্রেনেড হামলা
.............................................................................................
সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে উঠুক
.............................................................................................
মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে শুরু শারদীয় দুর্গোৎসব
.............................................................................................
জিপিএ ফাইভ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর বিসিএসের নামই কি সফলতা!
.............................................................................................
আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্প
.............................................................................................
কেন ভর্তি হবেন ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগে
.............................................................................................
বাংলাদেশ ও জ্বালানি তেল
.............................................................................................
বিদ্রোহী কাজী নজরুল
.............................................................................................
চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও মানবাধিকার প্রদান করতে হবে
.............................................................................................
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় : প্রজন্মে প্রজন্মের যাত্রা
.............................................................................................
২১ আগস্ট ১৫ আগস্টেরই ধারাবাহিকতা
.............................................................................................
পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে: নেপথ্যে কারণ...
.............................................................................................
ভয়াবহ একটি দিবস ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট
.............................................................................................
১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস : বাংলাদেশ উন্নত বিনির্মাণের প্রকৃত কারিগর যুবকেরা
.............................................................................................
বৃদ্ধাশ্রম নয় বরং প্রয়োজন সন্তানের ভালোবাসার
.............................................................................................
শত বাঁধা পেরিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে জবি
.............................................................................................
নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ
.............................................................................................
গৌরব, আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের পদ্মা সেতু
.............................................................................................
আত্মহত্যাকে না বলি জীবনকে উপভোগ করতে শিখি
.............................................................................................
আত্মহত্যা নয়, বেঁচে থাকায় জীবন
.............................................................................................
আপোষহীন আবুল মাল মুহিত
.............................................................................................
প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’
.............................................................................................
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু
.............................................................................................
জগন্নাথের গর্ব ভাষা শহীদ রফিক
.............................................................................................
ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এবং সম্ভাব্য প্রস্তুতি
.............................................................................................
দেশকে এগিয়ে নিতে ছিন্নমূল পথশিশুদের পুনর্বাসন করতে হবে
.............................................................................................
বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগ একটি অপরটির পরিপূরক
.............................................................................................
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পূর্বশর্ত স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন
.............................................................................................
ইউপি নির্বাচন : দলীয় প্রতীক তৃণমূলে দলের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে!
.............................................................................................
টিকটক এবং সামাজিক অবক্ষয়
.............................................................................................
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প
.............................................................................................
করোনায় বেকারদের অবস্থা শোচনীয়
.............................................................................................
অবক্ষয়ের নতুন ফাঁদ ‌টিকটক
.............................................................................................
রাষ্ট্র, আইন এবং রোজিনারা
.............................................................................................
পথশিশুরাও মানুষ
.............................................................................................
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও চর উন্নয়ন
.............................................................................................
নির্ভীক পদচারণার ৫০ বছর
.............................................................................................
সর্বত্র জয় হোক বাংলা ভাষার
.............................................................................................
বাঙালির চেতনা ও প্রেরণার প্রতীক একুশে ফেব্রুয়ারি
.............................................................................................

|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
    2015 @ All Right Reserved By dailyswadhinbangla.com

Developed By: Dynamic Solution IT