মহিউদ্দিন: ক্ষুধা, পুষ্টিহীনতা, খাদ্য অপচয় এবং অনিরাপদ খাদ্য বিবেচনায় বাংলাদেশে খাদ্য অনিরাপত্তার প্রকৃত চিত্র ভয়াবহ সীমায় পৌঁছেছে। অথচ বিগত বছরগুলোতে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়লেও বাড়েনি খাদ্য নিরাপত্তা। এ খাতে রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি বাড়লেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তাই খাদ্য নিরাপত্তায় অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য অধিকার আইন বাস্তবায়ন জরুরি পড়েছে। বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সূচক ২০১৫ অনুসারে, বিশ্বের ১০৯টি দেশের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯তম। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২২টি দেশের মধ্যে ২১তম। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমানে বিশ্বের ৯২ দশমিক ৫ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্যাভাবে আছে। মূলত খাদ্য অধিকার নিশ্চিতে আইন না থাকায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ আবেদন করার কোনো স্থান পায় না। অথচ এ পরিত্রাণের জন্য ইতোমধ্যে পাশের দেশ ভারতসহ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া ও আরও অনেক দেশে খাদ্য অধিকার আইন করা হয়েছে। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের পর্যালোচনায় দেখা যায়, খাদ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশে কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় দারিদ্রপীড়িত মানুষের রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার কোনো জায়গা নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়লেও, কৃষিতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উদ্বেগের বিষয় যে ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ যথেষ্ট রক্ষণশীল উপায়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি ও নীতি কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে খাদ্য অধিকার বিষয়ক আইনি কাঠামো অবশ্যাম্ভাবী পড়েছে। আইনের ফলে খাদ্য অধিকার নিশ্চিত হবে সেই সঙ্গে সরকারের কাছে দারিদ্র সমাজ তাদের অধিকার নিয়ে দাবি তুলতে পারবে বলে মত বিশ্লেষকদের। খাদ্য অধিকার নিশ্চিতে আইন না থাকায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ আবেদন করার কোনো স্থান পায় না বলে মন্তব্য করেন খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের সভাপতি মিহির বিশ্বাস বলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভারত, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো অনেকটি দেশে ইতোমধ্যে খাদ্য অধিকার আইন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলেও তিনি জানান। যুগোপযোগী খাদ্য অধিকার আইনের সম্ভাব্যতা দেখিয়ে গত ২৫ মে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের পক্ষ প্রতিনিধি দল ছায়া সংসদের প্রস্তাবিত ‘খাদ্য অধিকার বিল-২০১৪’ শীর্ষক আইনের প্রস্তাবনা সম্বলিত পুস্তিকা ডেপুটি স্পিকারের কাছে হস্তান্তর করেন। যা পরে সব সংসদ সদস্যের কাছে পাঠানো হয়। প্রস্তাবিত সেই আইনের খসড়ায় বলা হয়, খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে খাদ্যের প্রাপ্যতা, অভিগম্যতা ও পর্যাপ্ততা থাকতে হবে, যাতে কেউ বঞ্চিত না হয়। এজন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। যাতে রাষ্ট্র খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। খাদ্য অধিকার আইনের গুরুত্বের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, ‘এই মূহূর্তে আমাদের দেশে সকলের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য রয়েছে। তবুও সবাই খাদ্য পায় না। কারণ, কিছু মানুষ আছে যাদের উৎপাদনের সুযোগ নেই অথবা তাদের আয় নেই যাতে তারা ক্রয় করতে পারে। তবে এদের কেউই না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। তবে তিন বেলা সুষম খাদ্য যেটা দরকার তা তারা পাচ্ছে না। তিনি মনে করেন, উৎপাদনে সমস্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। বলেন, ‘এখন দেশে আমাদের জন্য খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে একদিকে কৃষি জমি কমছে অন্যদিকে মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ায় দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এই বিষয়গুলো সামনে রেখে যে আইনটি হবে তা একধরনের সিম্বল।’ তিনি আরো বলেন, ‘আইন হলে সরকারের তখন দায়িত্ব হবে সমাজে পিছিয়ে থাকা দরিদ্রদের খাবার নিশ্চিত করা। সরকার এখন এ বিষয়ে একমত হলেও আইন না থাকায় সুস্পষ্ট কোনো অধিকার আমাদের এখনো আইন দ্বারা সৃষ্ট হয়নি। আইন হবার পর আমরা আমাদের অধিকার চেয়ে নিতে পারব। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব। মূলত এই লক্ষ্য থেকেই আইনটি বাস্তবায়নে আমরা সরকারকে তাগিদ দিয়ে আসছি।’ সরকারের কাছে উপস্থাপিত তাদের প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে খাদ্য তৈরি, উৎপাদন ব্যবস্থা, খাদ্য প্রাপ্যতা, সুষম খাদ্য নিশ্চিত করা, সমাজে পিছিয়ে পড়াদের খাদ্য নিশ্চিতকরণসহ খাদ্য নিরাপত্তার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।